মহামারীর মধ্যে সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা এক-তৃতীয়াংশের বেশি বাংলাদেশি কর্মীকে নানা জটিলতার কারণে ফেরত পাঠানো সম্ভবপর হবে না বলে মনে করছে জনশক্তি রপ্তানিকারকরা। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা) সংসদীয় কমিটিকে একথা জানিয়েছে।
সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বায়রার পক্ষে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরা হয়। বায়রা বলছে, সৌদি দূতাবাস বাংলাদেশি পাসপোর্ট থাকার পরেও আলাদা করে নতুনভাবে পুলিশ ভেরিফিকেশন চেয়েছে। তাছাড়া ভিসা প্রক্রিয়া স্থগিত রেখেছে। সেই প্রক্রিয়া সময় সাধ্য।
“ওই ভেরিফিকেশন আসতে আসতে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এতে করে নিয়োগকর্তারা বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ দিতে অনীহা প্রকাশ করছে।” ঢাকাস্থ সৌদি দূতাবাসের সার্কুলার অনুযায়ী একজন কর্মীকে সব কার্যক্রম পুনরায় করে পাঠানো ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ উল্লেখ করে বায়রার পক্ষ থেকে বলা হয়, “এ প্রক্রিয়ায় প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ভাগ কর্মীর ক্ষেত্রে তাদের কর্মস্থলে যোগদান করা প্রায় অসম্ভব।” এ প্রক্রিয়াকে সহজ করার জন্য জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে বায়রা। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবে ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় কাজ করেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে যে এক হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স দেশে এসেছে, তার মধ্যে ৪০১ কোটি ৫১ লাখ ডলারই সৌদি প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন।
করোনাভাইরাস মহামারীকালে সৌদি আরব প্রবাসী যারা দেশে এসেছিলেন, দেশটির সরকার বিমান চলাচল পুনরায় শুরু করলেও বাংলাদেশ থেকে যাওয়ায় দেখা দেয় বিপত্তি। বিমানের টিকেট পেতে সৌদি প্রবাসীদের বিক্ষোভের পর সেই জটিলতা অনেকটা কাটলেও প্রবাসীদের দুর্ভোগের অবসান এখনও ঘটেনি।
৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বায়রা জানায়, রিক্রুটিং এজেন্সির হাতে প্রক্রিয়াধীন প্রায় ৮৬ হাজার কর্মীকে মহামারীর কারণে সৌদি আরবে পাঠানো যায়নি, ইতোমধ্যে তাদের ৮০ শতাংশের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। নতুন প্রক্রিয়ায় ভিসা সংগ্রহ করা দুঃসাধ্য। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কো-অর্ডিনেশন সেলের গঠনের প্রস্তাব করেছে বায়রা, দক্ষতা সম্পন্ন অথবা সৌদি সরকারের উচ্চপর্যায়ে ব্যক্তিগত যোগাযোগ আছে এমন ব্যক্তিদের তাতে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশও করা হয়েছে।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বায়রার সুপারিশে আরও বলা হয়, যে সব কর্মী ছুটিসহ বিভিন্ন কারণে দেশে আসার পর মহামারীর কারণে কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারেননি বা বর্তমানে যাদের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি, যারা যাওয়ার চেষ্টা করছেন জরুরী ভিত্তিতে তাদের একটি ডাটাবেইজ প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এদিকে বায়রার পক্ষ থেকে ২০১২ সালে প্রণীত মানব পাচার আইন রিক্রুটিং বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিদের জন্য হয়রানিমূলক উল্লেখ করে তাদের ২০১৩ সালে প্রণয়ন করা অভিবাসন আইনের আওতায় রাখার দাবি জানানো হয়।
বায়রার সভাপতি বেনজীর আহমেদ সংসদীয় কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা যারা বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক মালিক বিদেশে কর্মী পাঠিয়ে থাকি, আমাদের কেউ মানব পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। কিন্তু দেখা যায় কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়, এটা হয়রানিমূলক।” বায়রার সভাপতি বেনজির আহমেদ এবং মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান স্বাক্ষরিত লিখিত বক্তব্যে প্রতারণা বা চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ তদন্তের আগে রিক্রুটিং এজেন্সির কার্যক্রম বন্ধ না করার দাবি জানানো হয়।
সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কমিটিকে জানানো হয়, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এ বছর ২০৪টি রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে ১৬৩টি এজেন্সির লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছিল। বৈঠকে নিবন্ধিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বাইরে কেউ বিদেশগামী কর্মীদের সঙ্গে কোনো ধরনের লেনদেনে সম্পৃক্ত থাকলে তাদের শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি।
বৈঠকে জানানো হয়, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের নীতিমালা অনুযায়ী শুধুমাত্র বৈধ ও নিবন্ধিত অভিবাসী মৃত কর্মীর পরিবারকে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের নিয়ম থাকলেও বর্তমানে করোনাভাইরাস মহামারী বিবেচনায় অবৈধ বা অনিবন্ধিত মৃত অভিবাসীর পরিবারকেও এ সহায়তা দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত বিদেশগামীদের সহায়তার জন্য ভিসার মেয়াদ বাড়ানো, বিমানের ফ্লাইট বাড়ানো, আর্থিক সহায়তা দেওয়াসহ নানামুখী পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানায় মন্ত্রণালয়। কর্মীদের বিদেশ যাওয়া আরও সহজ করতে আগামী বৈঠকে বাংলাদেশ বিমানের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলোচনা করবে সংসদীয় কমিটি। কমিটির সভাপতি আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সভাপতিত্বে কমিটির সদস্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ, আলী আশরাফ ও সাদেক খান বৈঠকে অংশ নেন।
Comments