সামাজিক নিরাপত্তা খাত / সংস্কার হলে মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করবে: এডিবি
কোভিড–১৯ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের আগেই বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে বড় সফলতা পেয়েছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৯ সালে তা ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে। তবে এখনো অনেক কাজ বাকি। জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, অর্থাৎ তাদের দৈনিক আয় ৩ দশমিক ২০ ডলারের নিচে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সামাজিক নিরাপত্তা খাত বিশেষজ্ঞ হিরোকো উচিমুরা–শিরোইশি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো যেসব দেশ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে, তাদের জন্য মহামারির মতো ঘটনা বড় ধাক্কা; এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, কার্যকর সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা কতটা।’ কোভিড–১৯–এর প্রকোপের কারণে সংক্রমণ প্রতিরোধমূলক নানা ব্যবস্থা নিতে হয়, যার কারণে একই সঙ্গে সরবরাহ ও চাহিদা ব্যবস্থা বড় ধরনের ধাক্কা খায়; বিপুল পরিমাণ মানুষের চাকরি যায়, ফলে দরিদ্র মানুষের আয় কমে যায়। খাদ্যস্বল্পতা এবং উৎপাদন ও সরবরাহ জটিলতার কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত যুক্ত হলে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ যে অগ্রগতি অর্জন করেছিল, সেখান থেকে সহজেই ছিটকে পড়তে পারে। বাংলাদেশে প্রায়ই ঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস হয়, যার কারণ দরিদ্র ও অরক্ষিত মানুষেরা বিশেষভাবে আক্রান্ত হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন ও মহামারির প্রভাব মোকাবিলায় সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা দরকার। সে কারণে সরকার সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্তিশালী করতে কোভিড–১৯ মহামারিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চায়। এর মধ্য দিয়ে দরিদ্র মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা তৈরি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পুনরুদ্ধার জোরদার করাও তার লক্ষ্য।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার বিকাশে মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন করে। সরকার তখন মানুষের জীবনচক্রভিত্তিক অধিকতর সমন্বিত কৌশল প্রণয়ন করে। এই কৌশলের অধীনে সরকার যে অর্থ ব্যয় করছে, তা থেকে আরও ভালো ফল পেতে সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করার চেষ্টা করছে। সরকারকে সহযোগিতা করতে জাইকার সঙ্গে তখন এডিবি, জাপান ফান্ড ফর প্রসপেরাস অ্যান্ড রেজিলিয়েন্ট এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক যোগ দেয়, অর্থাৎ সামাজিক সক্ষমতা কর্মসূচিতে সহায়তা করতে তাদের এই উদ্যোগ।
এই উদ্যোগ মূলত সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির তিনটি খাতে নীতি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়: কর্মসূচির আওতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা ও জীবনচক্রের সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত চাহিদার বিষয়টি আরও ভালোভাবে আমলে নেওয়া।
কর্মসূচির আওতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি
আরও বেশিসংখ্যক জ্যেষ্ঠ নাগরিক, বিধবা ও প্রান্তিক নারীকে প্রাসঙ্গিক ভাতা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা হয়। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়, সে জন্য এই কর্মসূচির আওতায় দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বাজেট ব্যবস্থাপনা নির্বিঘ্ন ও দ্রুততর করতে এমআইএস তৈরি ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা হয়। এ লক্ষ্যে সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তি জোরদার করা
ব্যাংকের আওতার বাইরে থাকা মানুষদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় নিয়ে আসতে এমএফএস সেবার উন্নয়ন ও এমএফএস হিসাব খোলার প্রক্রিয়া সহজ করা হবে, এতে আর্থিক সেবা জনগণের আরও হাতের নাগালে আসবে।
জীবনচক্রের চাহিদা আমলে নেওয়া
মানুষের জীবনচক্রে একেক সময় একেক চাহিদা সৃষ্টি হয়। এই কর্মসূচির লক্ষ্য হচ্ছে, সরকার যেন এসব চাহিদা আমলে নিতে পারে, সে জন্য তাকে সহায়তা করা। বিশেষ করে মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, নারী–পুরুষ, ছেলে–বুড়ো সবার জন্যই। ভবিষ্যতে সংক্রামক রোগের প্রস্তুতি জোরদার করতেও এটি সহযোগিতা করবে, বিশেষ করে মহারারির ক্ষেত্রে। এ ছাড়া নগর দরিদ্রদের জন্য বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ঘটানোও এর লক্ষ্য।
এই কর্মসূচিতে সহায়তা করছে জাপান ফান্ড ফর প্রসপেরাস অ্যান্ড রেজিলিয়েন্ট এশিয়া।
সমাজের ঘুরে দাঁড়ানোর পথে
দেশে সামাজিক নিরাপত্তা থাকলে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এডিবির সামাজিক নিরাপত্তা খাত বিশেষজ্ঞ হিরোকো উচিমুরা–শিরোইশি বলেন, জরুরি অবস্থা, বিপর্যয়—এসব থেকে মানুষ দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারে যদি তাদের তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্য, সামাজিক ও আর্থিক প্রয়োজনীয়তা মেটানোর ব্যবস্থা থাকে। তিনি আরও বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশ যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছে, তাতে দেশটি বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জনের পথে। এসব বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের সমাজ আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে, মানুষের পরিবর্তনশীল চাহিদা আমলে নেওয়া যাবে।
এসব সংস্কার কর্মসূচি যথেষ্ট প্রতিশ্রুতিশীল। ২০২৩ সালে এসব কর্মসূচি শেষ হলে দেশের ২৬০টি উপজেলার সুরক্ষা পাওয়ার যোগ্য সব মানুষ অন্তত দুটি ভাতা কর্মসূচির আওতায় চলে আসবেন, ২০২০ সালের তুলনায় যার সংখ্যা হবে দ্বিগুণের বেশি। বিশেষ করে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরাই এসব কর্মসূচির আওতায় আসবে, বিশেষ করে অরক্ষিত জ্যেষ্ঠ নাগরিক ও নারীরা। মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা বা এমএফএসের ক্ষেত্রে সরকার যে পরিবর্তন নিয়ে আসছে, তাতে মানুষের পক্ষে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আসা সহজ হবে।
এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি একসূত্রে নিয়ে আসার যে চেষ্টা করছে, তাতে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আরও জোরদার হবে। সামাজিক কর্মসূচির প্রশাসনিক ব্যবস্থার একীভূতকরণ ও ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে মানুষকে আরও দ্রুত সেবা দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। এই কর্মসূচি শেষ হলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি তিনটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে আসবে। এ ছাড়া নগদ অর্থভিত্তিক যেসব কর্মসূচি আছে, সেগুলো প্রমিত ও সমন্বিত ব্যবস্থার অধীনে চলে আসবে।