চট্টগ্রামে মার্কিন বিমান ও সেনা উপস্থিতি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা, আসলে কী ঘটছে
বাংলাদেশের চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমান বন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর কয়েকটি সামরিক বিমান ও বেশ কিছু সদস্যের যাতায়াত ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তুমুল আলোচনা।
চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থানরত কয়েকটি সামরিক বিমানের ছবি বা ভিডিও শেয়ার করে ফেসবুকে কেউ কেউ লিখছেন, "তিনটা আমেরিকার যুদ্ধ বিমান চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে, তাহলে কি আমেরিকার কাছে দেশ বিক্রি হয়ে গেলো ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য।"
অনেকে অভিযোগ করেছেন, ইউএস এয়ারফোর্সের এই অফিসাররা চট্টগ্রামের যে হোটেলে থাকছেন, সেখানকার গেস্ট রেজিস্টার খাতায় নিজেদের নাম বা পরিচয় নথিভুক্ত করা ছাড়াই উঠেছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও গ্রুপে এরকম অসংখ্য পোস্ট ও ভিডিও শেয়ার করতে, মন্তব্য করতে দেখা গেছে।
আসলে ঠিক কী ঘটছে চট্টগ্রামে ইউএস বিমান বাহিনীকে ঘিরে?
বাংলাদেশের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর মঙ্গলবার ও বুধবার- দুইদিন দুইটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, চট্টগ্রামে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক এয়ার ফোর্সের অংশগ্রহণে সাত দিনব্যাপী " অপারেশন প্যাসিফিক এঞ্জেল ২৫-৩ " যৌথ মহড়া চলছে।
অর্থাৎ সে কারণেই ইউএস বিমান বাহিনীর ওই সদস্যরা চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন।
আইএসপিআর এও জানিয়েছে, এমন মহড়া নতুন কোনো বিষয় নয়। এর আগেও বাংলাদেশের বাহিনীর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর এমন যৌথ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
অন্যদিকে, ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ফেসবুক পেইজেও এই যৌথ মহড়ার খবর পোস্ট করা হয়েছে। যৌথ মহড়ার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছে গণমাধ্যমে।
এতে বলা হয়েছে, প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল মহড়ার মাধ্যমে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এগিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ।
এদিকে, চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লু হোটেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নথিভুক্ত হওয়া ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অতিথি সেখানে থাকছেন এমন অভিযোগ সত্য নয়।
চট্টগ্রামে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক এয়ার ফোর্সের অংশগ্রহণে সাত দিনব্যাপী " অপারেশন প্যাসিফিক এঞ্জেল ২৫-৩ " যৌথ মহড়া চলছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব বক্তব্য ছড়িয়েছে
মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে হযরত এম হাসান নামে একটি পেইজ থেকে চট্টগ্রামের বিমান বন্দরে ইউএস এয়ারফোর্স নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে।
সেখানে লেখা হয়েছে, " চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে মার্কিন বিমান বাহিনীর ৩টি সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস বিমান সহ ব্যাটেল ফিল্ডে ব্যবহার করা বেশ কয়েকটি ফাইটার হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গেছে।"
এই পেইজে স্ট্যাটাসের সাথে, বিমান বন্দরে থাকা মার্কিন বিমানগুলোর এবং ইউএস বিমান বাহিনীর সদস্যদের লাগেজসহ রেডিসন ব্লু হোটেলের ভেতরে অবস্থান করার একটি ভিডিও দেয়া হয়েছে।
এতে একজনকে বিমানগুলো দেখিয়ে বলতে শোনা যাচ্ছে, ইউএস এয়ারফোর্স বাংলাদেশের চট্টগ্রামের এয়ারপোর্টে এবং তিনি দুবাইতে যাওয়ার সময় চট্টগ্রামে এটা দেখছেন।
ওই স্ট্যাটাসে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, " একই সাথে "বাংলাদেশ সেনাবাহিনী" দ্বারা পরিচালিত "হোটেল রেডিসন ব্লু" তে রেজিস্ট্রারে এন্ট্রি ছাড়া ১২০ জনের অধিক মার্কিন সেনা রুম বুকিং নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।"
এই পেইজের পোস্টটি আরো অনেককেই শেয়ার করতে দেখা গেছে।
বুধবার সারাদিন অনেককেই ফেসবুকে এ বিষয়টিকে নিয়ে নানা মন্তব্য করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
জাহিদুল হাসান নামে এক ব্যক্তি ওই পেইজের ভিডিওটি শেয়ার করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, " ৩টা আমেরিকার যুদ্ধ বিমান চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে, তাহলে কি আমেরিকার কাছে দেশ বিক্রি হয়ে গেলো ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য।"
আবুল বাশার নামে একজন ব্যক্তি বাংলাদেশের একটি টেলিভিশনের এ সংক্রান্ত ভিডিও সংবাদ শেয়ার করে আরেকটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, " খাল কেটে কুমির নিয়ে আসার ফল এই দেশের। মানুষ ভোগ করবে, বাংলাদেশের মাটিতে আমেরিকার সেনাবাহিনী কারণ কি? এটা তো কোন সামরিক মহড়া না, দেশ দখলের প্রক্রিয়া।"
জাহিদ হোসেন পারভেজ নামের একজন ব্যক্তি এমন মহড়া বৃদ্ধির কারণ কি? এমন প্রশ্ন করে, ১৬ ঘণ্টা আগে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করেছেন।
জাহিদ হোসেন পারভেজ নামের একজন ব্যক্তি এমন মহড়া বৃদ্ধির কারণ কি? এমন প্রশ্ন করে, কয়েক ঘণ্টা আগে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করেছেন।
তিনি বিশাল ওই পোস্টে লিখেছেন, "বেশ কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি, বাংলাদেশে মার্কিন সেনাদের আনাগোনা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রশিক্ষণের নামে কখনো সিলেটে মহড়া কখনো কক্সবাজারের মহড়া কখনো চট্টগ্রামে মহড়া। আসলে মূলত এসব মহড়া বৃদ্ধির কারণ কি?"
চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লু হোটেলে রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই ১২০ জন মার্কিন সৈন্যকে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও এই ব্যক্তি তার পোস্টে দাবি করেছেন।
ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের ফেসবুক পেইজেও এই যৌথ মহড়ার খবর পোস্ট করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আইএসপিআর যা বলছে
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই বিষয়ে জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক এয়ারফোর্সের অংশগ্রহণে সাত দিনব্যাপী " অপারেশন প্যাসিফিক এঞ্জেল ২৫-৩ " যৌথ মহড়া চলমান রয়েছে।
এই মহড়া আগামীকাল অর্থাৎ ১৮ই সেপ্টেম্বর শেষ হবে।
মহড়ার আওতায় উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ অনুশীলন, কমব্যাট ট্র্যাকিং, সারভাইভাল এক্সারসাইজ অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশে এমন মহড়া এবারই প্রথম নয় বলে জানিয়েছে আইএসপিআর।
সামরিক বাহিনীর এই সংস্থাটি জানিয়েছে, মহড়ার অংশ হিসেবে আজ(বুধবার) আকাশ, স্থল ও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার বিভিন্ন ধরনের মহড়া পরিচালনা করা হয়।
এছাড়াও এই মহড়ায় অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে।
আইএসপিআর মঙ্গলবার দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, এই মহড়ায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি সি-১৩০জে পরিবহন বিমান, একটি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার এবং প্যাসিফিক এয়ার ফোর্সের দুইটি সি-১৩০জে পরিবহন বিমান অংশ নিয়েছে।
এছাড়াও বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর দেড়শ সদস্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক এয়ার ফোর্সের ৯২ জন সদস্যের অংশগ্রহণে এই মহড়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের বক্তব্য
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের ফেসবুক পেইজেও এই যৌথ মহড়ার খবর পোস্ট করা হয়েছে।
যৌথ মহড়ার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছে গণমাধ্যমে।
এই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল মহড়ার মাধ্যমে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এগিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ।
এতে বলা হয়েছে, চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স অ্যাম্বাসেডর ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন ১৬ই সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের জহুরুল হক সেনানিবাসে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল ২৫ মহড়া পর্যবেক্ষণ করেন।
মানবিক সহায়তা এবং দুর্যোগ মোকাবিলাকে কেন্দ্র করে পরিচালিত সাত দিনের বহুপাক্ষিক এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ৯২ জন এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ৯০ জন সদস্য, শ্রীলঙ্কা বিমান বাহিনীর দুই জন চিকিৎসা কর্মী, ওরেগন এয়ার ন্যাশনাল গার্ড, এবং আঞ্চলিক সহযোগী অংশীদাররা।
মহড়ার মূল লক্ষ্য চিকিৎসা প্রস্তুতি, বিমান নিরাপত্তা, প্রকৌশল সহায়তা, এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস।
তবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এমন যৌথ মহড়ার ইতিহাস এবারই প্রথম নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর দুই দেশের যৌথ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
২০১৫ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, সমুদ্রে কৌশলগতভাবে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য পঞ্চমবারের মতো যৌথ মহড়ায় অংশ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের নৌবাহিনী। ২০২২ সালেও এরকম মহড়ায় অংশ নিয়েছিল দুই দেশ।
ভিডিওতে ইউএস এয়ারফোর্সের একজন সদস্যকে এই মহড়া কেন ও কি নিয়ে সেটি সাক্ষাৎকার দিতে দেখা গেছে।
বিনা তথ্যে হোটেলে থাকার তথ্য কতটা ঠিক?
চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লু হোটেলে যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারফোর্সের পোশাক পরিহিত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যে ভিডিও শেয়ার করে অনেকে স্ট্যাটাসও দিয়েছেন।
ফেসবুকে বিভিন্ন ব্যক্তিকে এমন অভিযোগ করতে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ওই সদস্যরা হোটেলের গেস্ট বুকে রেজিস্ট্রেশন করা ছাড়াই সেখানে উঠেছেন।
কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, এমন অভিযোগ সত্য নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হোটেল কর্তৃপক্ষের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, " ইউএসের একটা গ্রুপ এসেছে এখানে। অ্যারাউন্ড ওয়ান হানড্রেড(প্রায় একশত)।"
তিনি জানান, অন্যান্য অতিথিদের যেভাবে হোটেলে পাসপোর্ট, ভিসা কপি দিয়ে উঠতে হয় ঠিক সেভাবেই তাদের বেলায়ও সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে।
কিন্তু তারা যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারফোর্স সদস্য কি না তা তিনি নিশ্চিত নন বলে উল্লেখ করেন। তবে তারা সামরিক বাহিনীর বলে অনুমান করেন এই কর্মকর্তা।
" অন্য আট -দশটা গেস্টের সাথে যে প্রসেস সেই প্রসেস ফলো করেই তারা আমাদের হোটেলে স্টে করছেন। রেডিসনের মতো একটা চেইন হোটেলের প্রটোকল প্রত্যেকটা গেস্টের জন্য সমান। যে কোন গেস্ট এখানে আসলে তার পাসপোর্ট, ভিসার কপি দিয়েই ঢুকতে হয় " বলেন এই কর্মকর্তা।
তারা সব ধরনের ডকুমেন্ট হোটেল কর্তৃপক্ষকে দিয়েই ওই হোটেলে থাকছেন বলে জানান তিনি।