ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অফ বাংলাদেশ-এফিলিয়েটেড মাইক্রোবায়োলজিস্টস (ISBM) আয়োজিত আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক ই-কনফারেন্স ২০২৫ গত ৬–৭ সেপ্টেম্বর সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
এ সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশি মাইক্রোবায়োলজি গবেষক, পেশাজীবী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে আধুনিক গবেষণা, নতুন আবিষ্কার, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে নতুন মাত্রা প্রদান করেন।
সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে আইএসবিএম এর প্রেসিডেন্ট ও নিউ ইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মোহসীন পাটওয়ারি বলেন, “আইএসবিএম হলো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ও বৈশ্বিক মাইক্রোবায়োলজিস্টদের জন্য এক শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা, উদ্ভাবন ও সহযোগিতা মিলিত হয়ে ভবিষ্যতের বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিচ্ছে। এ বছরের কনফারেন্সে ৬৫টিরও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনা এবং বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, আমরা জ্ঞান বিনিময় ও নতুন সুযোগ সৃষ্টির এক বৈশ্বিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছি।”
কনফারেন্স অর্গানাইজিং কমিটির চেয়ার ও ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ড এর অধ্যাপক আনোয়ার হক ১৭টি টাইম জোন থেকে আসা ১৭৫-এরও বেশি অংশগ্রহণকারীকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “আমরা দেশে-বিদেশে জ্ঞান ভাগাভাগি ও সহযোগিতার মাধ্যমে গবেষণা এবং সর্বোপরি জীবনকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারি।” তিনি সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য “মাইক্রোবায়োমঃ হেলথ এন্ড ডিজিজেস” তুলে ধরে বিশ্বব্যাপী মাইক্রোবায়োলজি গবেষক, পেশাজীবী ও শিক্ষাবিদদের একত্রে কাজের আহ্বান জানান।
আইএসবিএম-এর জেনারেল সেক্রেটারি ড. মিজানুর রহমান সংগঠনের বহুমুখী কার্যক্রম তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন যে আইএসবিএম নিয়মিতভাবে বৈজ্ঞানিক ইভেন্ট আয়োজন, সংক্রামক রোগ নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ওয়ান-টু-ওয়ান মেন্টরশিপ, টেকনিক্যাল ট্রেইনিং, স্কলারশিপ, ফেলোশিপ, ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ড এবং বিভিন্ন ধরনের গবেষণা গ্রান্ট প্রদান করে আসছে। তিনি বলেন,“আমাদের কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করতে দেশ-বিদেশে অবস্থানরত মাইক্রোবায়োলজি গবেষক, শিক্ষক, প্রফেশনাল, নীতি নির্ধারক, এবং শিক্ষার্থীরা যদি সদস্যপদ গ্রহণ, সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অনুদানের মাধ্যমে সহযোগিতা করেন, তবে বাংলাদেশি মাইক্রোবায়োলজিস্টরা বৈশ্বিক অঙ্গনে আরও দৃঢ়ভাবে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে।”
উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন আইএসবিএম-এর চিফ প্যাট্রন এবং বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর রিটা কলওয়েল, পিএইচডি, ডি.এসসি.। তিনি সংক্রামক রোগ গবেষণা এবং এনভায়রনমেন্টাল মাইক্রোবায়োলজিতে আন্তর্জাতিকভাবে অগ্রগণ্য ও স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ। উল্লেখ্য, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের সাবেক ডিরেক্টর এবং ন্যাশনাল মেডাল অফ সায়েন্স পুরস্কারজয়ী। তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্ক ও গবেষণা সহযোগিতার অভিজ্ঞতা উঠে আসে। তিনি আইএসবিএমের কার্যক্রমের প্রশংসা করেন এবং ভবিষ্যতের সফলতার জন্য শুভকামনা জানান।
প্লেনারি বক্তৃতায় আইসিডিডিআরবি-এর নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমীদ আহমেদ বিজ্ঞানের উদ্ভাবন ও জনস্বাস্থ্যের সংযোগের গুরুত্ব তুলে ধরেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মেজর জেনারেল (অব.) প্রফেসর ড. এএসএম মতিউর রহমানকে মাইক্রোবায়োলজি, বিজ্ঞান ও শিক্ষায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়।
সম্মেলনে বায়োটেকনোলজি, মলিকুলার বায়োলজি, ক্যান্সার, ইমিউনোলজি, পরিবেশ বিজ্ঞান ও বায়োইনফরম্যাটিক্সসহ অনুজীববিজ্ঞান সম্পর্কিত পাঁচটি মূল অধিবেশনে বক্তারা মাইক্রোবায়োলজি গবেষণার নতুন নতুন আবিষ্কার নিয়ে তাদের গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এই অধিবেশন গুলোর প্রধান বক্তা হিসেবে অধ্যাপক ড. এম.এ. মোতালেব (ইস্ট ক্যারোলাইনা ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র) লাইম ডিজিজ জীবাণুর জেনেটিক সার্কিট নিয়ে আলোচনা করেন। ড. নুর এ. হাসান (এরিয়াস বায়োসায়েন্স, যুক্তরাষ্ট্র) বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নতুন উপায় উপস্থাপন করেন। ড. হাসান জাকি (ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস সাউথওয়েস্টার্ন মেডিকেল সেন্টার, যুক্তরাষ্ট্র) ক্যান্সার ইমিউনোথেরাপিতে প্যাটার্ন রিকগনিশন রিসেপ্টরের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। পরিবেশ মাইক্রোবায়োলজির বৈশ্বিক অগ্রগতি তুলে ধরেন ড. হোসাইন এম. আজম (ইউনিভার্সিটি অব দ্য ডিসট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া, যুক্তরাষ্ট্র), এবং ড. ফাহিম কবির মনজুরুল হক (ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ) সীমিত সম্পদে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন।
তরুণ গবেষকদের জন্য আয়োজিত স্বল্পদৈর্ঘ্য গবেষণা উপস্থাপনা প্রতিযোগিতা সম্মেলনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল। এতে উদীয়মান বিজ্ঞানীরা নতুন ভ্যাকসিন, ড্রাগ রিপারপোজিং, মাইক্রোবিয়াল জেনোমিক্স, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স ও বায়োরেমিডিয়েশন বিষয়ক গবেষণা উপস্থাপন করেন। সেরা ১০ তরুণ গবেষককে নগদ পুরস্কার প্রদান তাদের সাফল্যকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ গবেষণায় প্রেরণা যোগাবে।
এছাড়া দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও প্রধানদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ইন্টার্যাকটিভ সেশনে শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণা অবকাঠামো, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, এবং শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গঠনের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হয়। মূল লক্ষ্য ছিল তরুণ মেধাবী মাইক্রোবায়োলজিস্টরা কিভাবে তাদের দক্ষতা ও জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ক্যারিয়ার গঠন, গবেষণা ও উদ্যোক্তা কার্যক্রমে এগিয়ে যেতে পারে, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা তৈরি করা। আলোচনায় মেন্টরশিপ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং গবেষণায় বিনিয়োগের গুরুত্ব বিশেষভাবে উঠে আসে।
সমাপনী অধিবেশনে কনফারেন্স সেক্রেটারি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সঙ্গীতা আহমেদ বলেন, “আমরা প্রতিষ্ঠিত ও উদীয়মান বিজ্ঞানীদের একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসছি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশি মাইক্রোবায়োলজিস্টরা জাতীয় পর্যায়ের পাশাপাশি বৈশ্বিক গবেষণায়ও নেতৃত্ব দিতে পারবে।”
আইএসবিএম আন্তর্জাতিক ই-কনফারেন্স ২০২৫ একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়ে শেষ হয়: কৌতূহল, সহযোগিতা ও সাহস—এই তিন স্তম্ভের উপরই বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটে, এবং বাংলাদেশি মাইক্রোবায়োলজিস্টরা আগামী দিনের আবিষ্কারে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।
Comments