নারী বৈষম্য দৃষ্টিভঙ্গি ও পুরুষতান্ত্রিক মিডিয়া প্রভাব

মেয়েদের বা নারীদের মূল্যায়ন করার মূল্যবোধ তৈরী করা না গেলে সমাজে অসমতা দুর হবে না। আর এক্ষত্রে মিডিয়ার প্রভাব অপরিসীম। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুক, টুইটার, বা ইন্সট্রগ্রামের সুবাদে চারপাশে বা সমাজে কি ঘটছে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়। স্বশরীরে সব জায়গায় না গেলেও চলে। অস্ট্রেলিয়ার মূল ধারার মিডিয়াতে নিয়মিত খেয়াল রাখতে গিয়ে একটা ব্যাপার খুব চোখে পরে। সেটা হচ্ছে মিডিয়া, প্রেস কনফারেন্স, রিপোর্টিং -এ মেয়েদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। আর শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে মিডিয়া ও প্রেসের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধি, অন্ধ, সহ পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠ তথা আদিবাসীদেরও উৎসাহী করা হচ্ছে নানা সুবিধা দিয়ে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশী্রা হচ্ছে বিপরীতমুখী। সম্প্রতি সিডনিতে একটি সিনেমার প্রেস কনফারেন্স দিয়েই প্রসঙ্গটা শুরু করি। তো সেই প্রেস কনফারেন্সে দেখা গেল কনফারেন্সে যিনি কথা বলছেন তিনি একজন পুরুষ, যারা সেখানে উপস্থিত হয়েছেন তাদের অধিকাংশই পুরুষ এবং জানা গেছে যারা এই কনফারেন্সটির আয়োজক তারাও পুরুষ। সমাজে নারী পুরুষের সমতা আনার যে কথা বলাবলি বা লেখালেখি হয় প্রবাসী বাংলাদেশী মিডিয়ার ক্ষেত্রে নারী বা মেয়েদের উপস্থিতিটাকে বিবেচনায় নেয়া হয়না মোটেও। বাংলাদেশী সমাজ অধিপতি বা নীতি নীর্ধরক যেহেতু এখনো বেশির ভাগ পুরুষ সেজন্য সেটাকে তারা নিজেদের জায়গা বলেই এখনো মনে করে আসছেন। তারা মনে করে মেয়েরা বড়জোর নাচ, গান বা কবিতা আবৃতি করলেই তাদের সামাজিক- সাংস্কৃতিক দ্বায়িত্ব পালন করা শেষ।
কিছুদিন আগে এক আড্ডার একটি প্রসঙ্গ ছিলো, মেয়েদের রূপ বর্ণনা নিয়ে এতো শত কাব্য কথা, গল্প-কবিতা, নাটক-উপাখ্যান লেখা হয় সে তুলনায় পুরুষদের নিয়ে লেখা হয়না কেন! উত্তরে একজন ভদ্রলোক বলেছিলেন প্রাণীদের মধ্যে পুরুষ প্রজাতি নাকি এম্নিতেই সুন্দর তাই তাদের রূপের বন্দনা করার দরকার হয়না। উদাহরণ হিসেবে তিনি ময়ূর, সিংহ, এবং আরো কিছু প্রাণীর প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। তখন অন্য আরেকজন যোগ করলেন ছেলেদের দেখার চোখ সুন্দর তাই তারা রূপ বর্ণনা করতে কার্পণ্য করেনা। একটু খেয়াল করলেই পরিষ্কার হবে যে, সবক্ষেত্রেই আসলে পুরুষ আধিপাত্য। সভ্যতার শুরু থেকেই তা হয়ে আসছে। অন্য সব প্রাণীদের মধ্যে পুরুষ প্রজাতি সুন্দর হলেও মানুষের ক্ষেত্রে সেটা সত্য নয়। স্বভাবগত ভাবে পুরুষ প্রজাতি নির্মম ও খানিকটা বর্বরোচিতও বটে। তারা শুধুমাত্র নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার স্বার্থে মেয়েদের টিকিয়ে রেখেছে। পৃথিবীর অনেক দেশে এখনো মেয়েদের প্রতি বর্বরোচিত আচরণ করা হচ্ছে। পৃথিবীতে বেশির ভাগ অপরাধ এখনো পুরুষদের দ্বারাই সংগঠিত হয়। আর মেয়েদের অন্যদের নিয়ে রূপ বন্দনা করার সময়ই বা কোথায়! ঘরেবাইরে কাজ করার পর নিজেদের জন্যই তো তারা সময় বের করতে পারেনা। পুরুষদের আছে অঢেল সময় আর সে সময় দিয়েই তারা কাব্য রচনায় বা রূপ বন্দনায় নিবৃত হয়।
কারো রূপ বন্দনা দুরে থাক মেয়েরা নিজেদের মত বা ভাবনা চিন্তা গুলো প্রকাশ করারই বা সমর্থন কতোটুকু পায়! পশ্চিমা দেশ গুলোতে যারা অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে তাদের সমতালে কাজ করার জন্য নানা রকম সুবিধা দেয়া হয়। এই যেমন বর্তমানে আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের জন্য কন্সটিটিউশন পরিবর্তন করার চিন্তা হচ্ছে। এছাড়াও চাকরী বা সেবা দানের ক্ষেত্রেও বাড়তি কোন সাহায্য লাগবে কিনা তার উপর গুরত্ব দেয়া হয় বা ক্ষেত্র বিশেষে নানা সুবিধাও রাখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশীদের বেলায় মেয়েদের সুযোগ তো দুরে থাক বরং যারা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে মিডিয়া বা লেখালেখিতে দক্ষতা অর্জন করার চেষ্টা করে তাদের নানা ভাবে দমিয়ে রাখতে তৎপর হয়ে পরে নামধারী সুশীল সমাজ। মেয়েদের সহযাত্রী বা সহযোদ্ধা হিসেবে সহযোগিতার হাত বাড়ানো দুরে থাক প্রতিদ্বন্ধী ভেবে বা তাচ্ছিল্য করে দুরে সরানোর নানা প্রয়াস চলে। যেন মিডিয়া বা লেখালেখি তাদের জন্য নয়। আর যদি নেহায়েত লেখালেখি করেও থাকে তারা যেন কেবল গল্প-কবিতা বা আত্নজীবনীতেই তাদের সীমারেখা এঁকে দেয়। জীবন দর্শন বা সমাজ, রাজনীতি, প্রেস-মিডিয়া তাদের জন্য নয়! অথচ সমাজে নারী পুরুষের অবদান সমান। শুধু পারিবারিক বা সংসার সামলানোই তাদের একমাত্র কাজ নয়।
প্রবাসে এসেও সমাজ সেবা মূলক যে কোন সভা-সমিতি, আলোচনা বা মত-বিনিময় ও মিডিয়া সমাবেশের মঞ্চে পুরুষরাই চেয়ার দখল করে বসে থাকেন। অবস্থাটা এমন যেন মেয়েদের কাজ তো কেবল ঘর সামলানো। এমনকি তারা অফিস বা বাইরের কাজ করে আসার পরও ঘরের আনুষঙ্গিক কাজ তাদের জন্য অবধারিত! সেজন্য পুরুষেরা মনে করে মেয়েরা বাইরের জগত তথা মিডিয়া, রাজনীতি, দর্শন বা বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা মতামত দেয়ার যোগ্যতা রাখেনা। এমনকি দর্শন, নীতিবিদ্যার মতো একাডেমিক অর্জন থাকলেও! তারা বড়োজোর কাজ শেষে সংসার সামলাবে, শাড়ি-গয়নায় সেজে কিংবা হিজাব-টিকলি পরে পার্টি বা আমন্ত্রন-নিমন্ত্রণ রক্ষা করবে। এটুকুতেই তাদের মানায় কেবল! সবচে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে মেয়েদের এই মেয়েলিপনা বা সংসারে আবদ্ধ করে রাখা নিয়ে প্রচারণা করেন সমাজের সুশীল নামধারীরা। তারা নিজেরা নিজেদের সাংবাদিক, সম্পাদক, নাট্যকার, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করে একধরণের আত্নতৃপ্তি বোধ করলেও মেয়েদের বা নারীদের শুধুই সংসারী বা মেয়েলি উপমায় বিশেষিত করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এই নামধারী সুশীলদের লেখা, পোষ্ট কিংবা আলোচনায় মেয়েদের মা-মেয়ে-বোনের তকমা লাগিয়ে রাখেন। ভাবনা-চিন্তা গুলো অত্যন্ত বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ ভাবে প্রকাশ করে থাকেন। আদতে তারা শুধু বলা, বা লেখাতেই মেয়েদের সম্মান করার একটা আবরণ ঝুলিয়ে রাখেন। বাস্তব সম্পূর্ণই ভিন্ন। এই যে মেয়েদের কেবল বই-পুস্তক আর বাহ্যিক ভাবে সম্মান দেখানোর একটা আবহ চলছে সেটা মিডিয়া বা সভাসমিতিতে মেয়েদের অবস্থান থেকেই অনুমান করা যায়।
শুধু মিডিয়ার ক্ষেত্রে নয়,মেয়েরা তাদের অধিকার আদায়ের লড়াই বারবর একাই চালিয়ে এসেছে সবকিছুতেই। আগামীতেও চালিয়ে যাবে একাই। তবুও আশা সুশীল সমাজপতিদের একটু বোধ উদয় হোক। শুধু মা-মেয়ে-বোনের উপমা বাদ দিয়ে তাদের উদারতা আরেকটু খানি প্রসারিত হোক। মেয়েদের সহযোদ্ধা আর সহযাত্রী ভেবে হাতে হাত, কাধে কাঁধ রেখে এগুতে পারলে পৃথিবীটা বোধকরি আরেকটু সুন্দর হতো। শুধু কথা আর কাব্যে নয়, মেয়েরাও যে সমাজে সমতালে অবদান রাখার যোগ্যতা রাখে সে ভাবনাটুকু প্রকাশিত হোক সুশীলদের বাস্তব আচরণে, দৈনন্দিন অভ্যাসে। একটি নিরপেক্ষ ও নির্ভরতার সমাজ তৈরী হয় নারী পুরুষের সমান্তরাল প্রয়াসেই! আর পারস্পরিক সমর্থন না থাকলে সবকিছু প্রশ্নসাপেক্ষই থেকে যাবে।
- ফ্রান্স বাংলাদেশকে আরো শক্তিশালী করে দিল
- রাষ্ট্রপতির অনুমতি ব্যতীত ড. ইউনুসের নোবেল প্রাইজ সংবিধানের লঙ্ঘন!
- শেখ হাসিনার উন্নয়ন ভাবনা দক্ষতা পাশে বসে কয়েকগুণ বাড়িয়েছেন শেখ রেহানা
- জাতিকে শঙ্কামুক্ত করতে শেখ হাসিনাকে হতে হবে বাংলাদেশের ‘আতাতুর্ক’
- বিশ্ব শরণার্থী দিবস ও জলবায়ু শরণার্থী
- গণতন্ত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহাসড়কের ইতিকথা
- অারো খবর