আমাদের দেশে নেতার ছেলে-মেয়ে নেতা হবে, এমপির বউ-ছেলে এমপি, অন্যান্য দেশে যদিও একটু ডিফ্রেন্ট, যেমন কে মানুষের কাছে আছেন, কে রাজনীতি করছেন, কাকে মানুষ ভালোবাসে (যেকোনো কারণে), কে দরজায় দরজায় লিফলেট বিতরণ করছে এসব বিষয়ের উপর নির্ভর করে কে নেতৃত্ব দিচ্ছে বা দিবেন। পাবলিকের ভোটের বিষয়।
বর্তমানে জনপ্রতিনিধিদের (এমপি বা চেয়ারম্যান) যেমন ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা নেই। যদিও এরকম শিক্ষাগত যোগ্যতা অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। জনপ্রতিনিধিদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশাসনের কার্যকারিতা এবং বাংলাদেশের মতো একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ বিষয় দেখবেন এবং নেতৃত্বের মান নির্ধারণ করতে সক্ষম হবেন। জনপ্রতিনিধিদের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচন করতে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা কি হতে পারে তা নির্ধারণ করার এখনই সময়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলেই তা করতে পারবে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায় চলে এসেছে, অথবা আসার অপেক্ষায় । মনে হচ্ছে বাংলাদেশে এবং বহির্বিশ্বে, যেখানে বাংলাদেশিরা বসবাস করছেন, সবখানেই বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে একটা ঈদ উৎসবের মত আমেজ কাজ করছে। নেতাদের কদর বেড়ে যাচ্ছে। বিএনপিকে সম্মান দেখিয়ে কথাবার্তা বলতেছেন। স্বপ্ন দেখা শুরু হয়ে গেছে! কে হবেন নেতা, কে হবেন পৌর চেয়ারম্যান, কে হবেন লোকাল লিডার, কে করবেন টেন্ডারবাজি, কে হবেন সংসদের এমপি, এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে লবিং। আবার কেউ কেউ হয়ত বুদ্ধিজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেও ভুলে যাচ্ছেন না। এখন থেকে কিছু কিছু বাক্য চয়ন করছেন যাতে করে তারেক জিয়ার নজরে পড়েন। আবার বিএনপি কখনো নির্বাচনের জন্য দাবি জানাচ্ছে এবং কখনো নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করার দাবি করছে। দেশের মানুষ কিন্তু আওয়ামী লীগের পর বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য ত্যাগ স্বীকার করে নাই, রক্তঝরায় নাই।
বাংলাদেশের জনগণ তারেক জিয়ার কর্মকাণ্ড ভুলে নাই। তারেক জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘সমালোচিত’ ব্যক্তিত্ব। তার মায়ের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যথেষ্ট অভিযোগ ছিল।
আমরা বুঝি ক্ষমতার বাইরে থাকা কতটুকু বেদনাদায়ক। কিন্তু বাংলার ছাত্র-জনতার রক্তের দাগ এখনো মুছে নাই। ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরিয়ে বহুল প্রত্যাশিত সংস্কার/পরিবর্তন নিয়ে আসছে। সুতরাং ধৈর্য ধারণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করা হবে সমীচীন।
জনপ্রতিনিধিদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা:
জনপ্রতিনিধিদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রবর্তণ দেশের শাসন ও নেতৃত্বের মান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে পারে। স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান ও এমপিদের জন্য স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা তাদেরকে জটিল চ্যালেঞ্জ নেভিগেট করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার সাথে সজ্জিত করবে না বরং জাতিকে নেতৃত্বের পথ হিসেবে শিক্ষাকে মূল্য দিতে এবং অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করবে। যেহেতু দেশ ক্রমাগত উন্নতি করছে এটি অপরিহার্য যে এ নেতারা সুশিক্ষিত এবং সুশাসনের নীতিতে গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
জনপ্রতিনিধিদের ন্যূনতম স্তরের শিক্ষার প্রয়োজনের জন্য একটি সেন্ট্রাল যুক্তি হল- নেতাদের জ্ঞাত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সমালোচনামূলক চিন্তার দক্ষতা, জ্ঞান এবং বোঝার ক্ষমতায়ন করে। গভর্ন্যান্স একটি জটিল বিষয়, অর্থনৈতিক নীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিয়ে নেতাদের কাজ করতে হয় । সংসদ সদস্যরা দেশের আইন প্রণয়ন করার গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। তাদের দায়িত্ব জাজদের চেয়েও বেশি | জাজরা তাদের আইনের প্রয়োগও ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন | কাজেই স্নাতক-স্তরের শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা, সমস্যা চিহ্নিত, বিশ্লেষণ, তাদের প্রভাবগুলি বুঝতে এবং কার্যকর সমাধান তৈরি করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে অবশ্যই সাহায্য করবে।
উদাহরণস্বরূপ- একজন শিক্ষিত প্রশাসক জনপ্রশাসন বা অর্থনীতি পটভূমিসহ অত্র এলাকায় সম্পদ বণ্টন ও পরিচালনা, উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনা এবং তাদের সম্প্রদায়ের চাহিদা পূরণের জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুত হবেন।
এমপি এবং চেয়ারম্যানদের জন্য শিক্ষার স্নাতক স্তরের প্রয়োজন। যা বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। এটি শিক্ষার গুরুত্বের সংকেত দেবে এবং তরুণ প্রজন্মকে উচ্চতর অধ্যায়নে উৎসাহিত করবে, এটা জেনে যে নেতৃত্বের ভূমিকার জন্য একটি পূর্বশর্ত। এর পরিবর্তে আরও শিক্ষিত এবং নিযুক্ত নাগরিকদের লালন-পালনের মাধ্যমে জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
অন্যান্য সংস্কার:
দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবেশ সৃষ্টি, বিসিএস পরীক্ষার আমূল পরিবর্তন, বিচার বিভাগের শুদ্ধিকরণ, পুলিশ, র্যাব, ডিজিএফআই, আর্মি, এবং প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে যোগ্য লোক নিয়োগ, এই সমস্ত সংস্কার কাজের আগে নির্বাচন দিলে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র আসবে না। দেশ স্থায়ীভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তড়িৎ নির্বাচন দেয়া মোটেই ঠিক হবে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিচার বিভাগ, পুলিশ, প্রশাসন, রাজনীতি সংস্কার করে যদি নির্বাচন দেয় তবেই বহুদলীয় গণতন্ত্র নিশ্চিত হবে । দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, ব্যাপক সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নিয়ে সংস্কার কাজে হাত দেয়া প্রয়োজন ।
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে নিয়োগ প্রক্রিয়া ও পদোন্নতির মানদণ্ড সংস্কারের এখনই সময়। ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে সংস্কার করা প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে এসব কাজ সম্ভব! অন্যরা তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে যে ব্যস্ত থাকবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায় !
বিচার বিভাগ একটি ক্রসরোডে দাঁড়িয়েছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা বাড়াতে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে এবং আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখতে বিচারিক নিয়োগ, মামলার ব্যাক লগ এবং পদ্ধতিগত অখণ্ডতার মতো সমস্যাগুলি অবশ্যই সমাধান করতে হবে। একইভাবে, দুর্নীতি দমন বিভাগ, মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে এবং কার্যকরভাবে অপরাধ দমনে তাদের সক্ষমতা জোরদার করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির মধ্যে সংস্কার অপরিহার্য। এ সংস্থাগুলিকে গণতান্ত্রিক নীতিগুলির সাথে সারিবদ্ধ করাতে কাঠামোগত পরিবর্তন এবং কঠোর তদারকি প্রক্রিয়াগুলি সর্বোত্তম। ইংল্যান্ডের মত ইন্ডিপেন্ডেন্ট পুলিশ কমপ্লেইন কমিশনসহ প্রত্যেকটি প্রশাসনে ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমপ্লেইন কমিশন গঠন করা আবশ্যক। প্রত্যেকটি ইনস্টিটিউশন রেগুলেটরি ফ্রেমের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন।
জাতীয় শাসনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা অত্যধিক রোধ, বেসামরিক কর্তৃত্বের আনুগত্য নিশ্চিত করতে স্পষ্ট তদারকির ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কার, পদোন্নতির মানদণ্ড এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা ভারসাম্য অর্জনের দিকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসনিক পদে প্রবেশদ্বার পক্ষপাত দূর করে মেধাতন্ত্রকে উন্নত করতে হবে এবং বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করতে এই পরীক্ষা ব্যবস্থার অবশ্যই সংস্কার করতে হবে। একইভাবে, অ্যাকাডেমিক মান বজায় রাখতে এবং রাজনীতিকরণ রোধ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং যোগ্যতা-ভিত্তিক নির্বাচনের মানদণ্ড প্রয়োজন।
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের বাইরে, বাংলাদেশ নিজেকে একটি অনন্য সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে খুঁজে পায়, যেখানে সম্পূর্ণ কার্যকরী রাজনৈতিক ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। একটি স্থিতিশীল সাংবিধানিক কাঠামোর অনুপস্থিতি গণতান্ত্রিক শাসনকে দুর্বল করে এবং অস্থিতিশীলতাকে স্থায়ী করে। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সাংবিধানিক সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ড. ইউনুস গং রা তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় আরোহণ করিয়ে সরে পড়তে আসেন নাই। তারা এসেছেন দেশের ক্রান্তিলগ্নে দেশকে রক্ষা করতে। দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সময় ও কর্তৃত্ব দিয়ে ক্ষমতাবান করতে জনগণের ম্যান্ডেট প্রয়োজন । একটি ‘হা’ ‘না’ ভোটের বিষয় সরকার চিন্তা করতে পারে।
পদ্ধতিগত ঘাটতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাত দূর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ আরও ন্যায্য, ন্যায়সংগত এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করতে পারে। সংস্কারের জন্য সাম্প্রতিক আন্দোলনে যে ত্যাগ স্বীকার করা হয়েছে তা অবশ্যই বৃথা যাবে না এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক নীতি দ্বারা পরিচালিত একটি জাতি গঠনের লক্ষ্যে সমর্থন করা এই জাতির জন্য এই মুহূর্তে মুখ্য বলে মনে করি।
লেখক: ব্যারিস্টার এম আব্দুস শহীদ
Comments