ব্যুরো হতে কমিশনে রূপান্তরের পর থেকে আলোচনা সমালোচনার কেন্দ্রে রয়েছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বড়ো কলেবরে ক্ষমতাসীন দলের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসহ দেশের খ্যাতনামা অনেককেই দুর্নীতিবাজদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে, শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে বর্তমান কমিশন।
অতিসম্প্রতি সাবেক আইজিপির দুর্নীতি বিষয়ে তদন্ত করে আবারও আলোচনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক কর্মকর্তারা মনে করেন গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. ইউনূস, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের দুর্নীতি ও এমএলএম কোম্পানির প্রতারণার মামলা দুদকের বড়ো সাফল্য। হলমার্ক ও ডেসটিনির শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের দুদকের মামলায় কারাবরণ করতে হয়েছে। বর্তমান সরকারের একজন সংসদ সদস্যকেও (কক্সবাজারের আবদুর রহমান বদি) দুর্নীতির মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছে। মহাজোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী এবং বর্তমান এমপির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগে মামলা দায়েরও সফলতা মনে করছে দুদক।
এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোটো ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর বিদেশে পাচার করা প্রায় সাড়ে ২১ কোটি টাকা ফেরত আনাকে নিজেদের সফলতা মনে করছেন বর্তমান কমিশন।
দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, সমালোচনার জায়গা হয়তো আছে তবে বর্তমান কমিশনের সফলতা অনেক। অনেক কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পেরেছে দুদক।
দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, আমরা দল না দেখে ব্যক্তির অপরাধ দেখে ব্যবস্থা নিয়েছি, নিচ্ছি। কে সরকারি দল আর কে বিরোধীদল এটা আমাদের কাছে বড়ো নয়।
দুদকের কন্ট্রোল রুম থেকে জানা গেছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত দুদক মোট তিন হাজার ৬৬২টি মামলা দায়ের করেছে। একই সময়ে কমিশন তিন হাজার ৭১২টি মামলার চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে এবং দুই হাজার ৩৩৭টি মামলার ফাইনাল রিপোর্ট বা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করেছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কমিশনের ১৩২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৬১টি মামলায় সাজা ও ৭১টি মামলায় আসামিরা খালাস হয়েছে। শতকরা হিসেবে প্রায় ৪৬ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দুদককে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই তথা আন্তর্জাতিক সংস্থার আদলে গড়ে তোলার নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুদকের গোয়েন্দা বিভাগের কার্যক্রম কেন্দ্র থেকে জেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের গতিবিধি অনুসরণে তথ্যপ্রযুক্তি ও কল রেকর্ডের জন্য নিজস্ব সার্ভার স্থাপন করেছে দুদক। মানুষের কাছ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ গ্রহণের জন্য একটি বিশেষ হটলাইন চালু করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপকে ইতিবাচক বলা যেতে পারে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদকের যতটুকু আইনি শক্তি ও জনবল রয়েছে তার মধ্যে থেকেই কমিশন যথাযথ কাজ করলে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেকটা পূরণ করতে পারবে।
দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দুদকের ক্ষমতার পরিধি বাড়ানো হয়েছে। দুদক এখন তদন্ত বা অনুসন্ধানের জন্য আয়কর বিভাগ এবং ব্যাংকগুলো থেকে ব্যক্তির যাবতীয় তথ্য সরাসরি তলব করতে পারে। গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে অভিযোগ অনুসন্ধান না করেই সরাসরি মামলা করতে পারে। বস্তুত আইন ও বিধি সংশোধন করে থানায় না গিয়ে নিজস্ব কার্যালয়ে মামলা করার ক্ষমতা পেয়েছে দুদক। এসব এখতিয়ার প্রয়োগে দুদককে প্রভাবশালীদের বিরাগভাজন হওয়ার ভয় পেলে চলবে না, সাহসিকতার পরিচয় দিতে হবে। তবে দুদকের একার পক্ষে দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল সম্ভব নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা। বস্তুত রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতির কারণেই দুর্নীতির রাশ টানা যাচ্ছে না। দুর্নীতিবাজদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে যে কোনো রাষ্ট্রের জনপ্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের একটি অনুকূল রাজনৈতিক পরিমণ্ডল প্রয়োজন। এটি অনুধাবন করতে হবে সবাইকে।
বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি পোষণ করে। দুর্নীতি দমন কমিশন যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেদিকে নজর জননেত্রী শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুর্নীতিবাজ যেই হোক না কেন তাকে ছাড়া হবে না। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং এর অর্জনসমূহ সমুন্নত রাখার জন্য সরকার তার দুর্নীতিবিরোধী লড়াই অব্যাহত রাখবে। তাঁর উপদেশ মেনে স্বাধীন ও স্বাতন্ত্র্যভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে দুদক। যে কারণে সম্প্রতি পুলিশের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করছে। আশা করা যায়, এই তদন্তেও দুদক সফল হবে। দুদক স্বাধীনভাবে আরও সাহসী পদক্ষেপ নেবে প্রত্যাশা সেটাই।
Comments