তিন দশক আগের ঘটনা। কিছুদিন যাবত বার বার সেই স্মৃতি আমায় তাড়িত করছে। বড্ড ধার্মিক লোক ছিলেন শিক্ষা অফিসার মিজানুর রহমান! ঘন ঘন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করতেন! সাঝ সকালে বেরিয়ে যেতেন। যে বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা বেশি, দশটা বাজার সাথে সাথেই সে বিদ্যালয়ের পাশে চায়ের দোকানে উনার দেখা মিলতো। কপাট খুলতেই ঢুকে যেতেন অফিস রুমে। সকালের নাস্তাটা হয়নি, তাই শিক্ষকদের নাস্তা আনার নির্দেশ দিতেন। বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে এদিক সেদিক কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে, পরিদর্শন বই হাতে নিয়ে লম্বা নোট লিখতেন। তাঁর পরিদর্শন রিপোর্টে কোন প্রশংসার বাক্য খুজে পাওয়া যেতো না। প্রতিটি শিক্ষক সম্পর্কেই কিছু নেতিবাচক কথা রিপোর্টে থাকতো। চলে যাওয়ার সময়, কে কখন উপজেলা শিক্ষা অফিসে উনার সঙ্গে দেখা করবেন, তার একটা তালিকা ধরিয়ে দিতেন।
যোহর আর আসরের নামাজের সময় তিনি কোন না কোন স্কুলে পরিদর্শনে থাকতেন। অফিস কক্ষে ঢুকেই শিক্ষকদের প্রতি নামাজের জায়গা করার আদেশ হতো। নামাজ শেষ হলে শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এসব নিয়ে কথা বলতেন। পরিদর্শনের সময় কোন শিক্ষকের ত্রুটি খুঁজে না পেলে অভিব্যক্তি ছিল , ‘আপনার সঙ্গে ছাত্রদের সম্পর্ক ভালো নয়’। এভাবেই তিনি সব শিক্ষককে নেতিবাচক রিপোর্টের আওতায় নিয়ে আসতেন। তার দেয়া সিডিউল অনুযায়ী যখন কোন শিক্ষক উপজেলা সদরে দেখা করতে যেতেন, প্রথমেই তিনি সাসপেনশনের হুমকি দিয়ে কথা শুরু করতেন। শিক্ষকরা কখনো শূন্য পকেটে উনার অফিসে যেতেন না। তবে সাথে নেয়া টাকা পয়সা দু’ভাগে ভাগ করে রাখতেন। ভাবতেন আগে একটি পকেট থেকে টাকা বের করে দিবেন। প্রথমেই সাসপেনশনের কথা শুনে, ভয়ে জড় সড় হয়ে, ডান বাম দু’পকেটের টাকাই মহোদয়ের হাতে তুলে দিতেন। টাকা পেলেই উনার চেহারা পাল্টে যেত। অফিস কর্মচারীদেরকে চা আনার নির্দেশ দিতেন। চা-নাসতা খেতে খেতে বলতেন, ‘নিয়মিত নামাজ-কালাম পড়বেন, সন্তানদের ধর্ম কর্ম শিখাবেন। আল্লাহর রহমতে যেকোন সমস্যায় পার পেয়ে যাবেন।’
শিক্ষকদের ইনক্রিমেন্ট, টাইম স্কেলের সময় আসলে মিজান সাহেবকে বড্ড খুশি খুশি লাগতো। আমার বাবা তো টাইম স্কেল ইনক্রিমেন্টের সময় খাতা কলম নিয়ে বসে যেতেন। আটচল্লিশ টাকা বেতন বাড়বে, তাঁর জন্য শিক্ষা অফিসারের মোহরানা পাঁচশত টাকা। বজরুল মাস্টার ধনী মানুষ, তিনি সেটা জানতেন! কথায় কথায় জানিয়ে দিলেন, তাঁর ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা খরচ দিতে হয়। মাসের পঁচিশ তারিখে তিনি মানি অর্ডার করেন। তাই বজলুল মাস্টারকে ২৩ তারিখে দেখা করার নির্দেশ দিলেন। যথা সময় মাস্টার মহোদয় শিক্ষা অফিসারের কক্ষে হাজির। সময়টা বেকায়দার! স্যার যোহরের নামাজে চলে গেলেন। যোহর, আছর গড়িয়ে মাগরিবের পর স্যার আসলেন। জানালেন, মসজিদে গেলে তিনি সবকিছু ভুলে যান। দুনিয়াদারীর কথা মাথায় থাকে না! তাই দুঃখ প্রকাশ করে বদরুল মাস্টারকে তাড়াতাড়ি টাকা বের করতে বললেন। দেন দরবারের সুযোগ না দিয়ে এক মাসের বেতনের সমপরিমাণের টাকা হাতিয়ে নিলেন। বিদায় বেলায় বজরুল মাস্টারের বড্ড প্রশংসা করলেন। জানিয়ে দিলেন কোন একদিন তাঁর বাড়িতে দাওয়াত খাবেন!!
গত ক’দিন যাবৎ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড নিয়ে পত্রপত্রিকায় তুলকালাম। বেরসিক পুলিশ আর ডিবি যেন উঠে পড়ে লেগেছে। আর এসব কাণ্ড যখন চোখের সামনে, শিক্ষা অফিসার মিজান সাহেবের কথা বড় বেশি মনে পড়ছে। জানিনা তিনি এখন ইহজগতে, নাকি আখেরাতে! উনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে এখন কোথায়? সেটি জানতেও মনটা এখন বড় বেশি আনচান করছে! এরই মাঝে পত্রিকা খবর দিয়েছে,পুলিশ কারিগরি বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয়ের স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছেন! তাতেও ডিবির মন ভুলেনি!! একসময়ের অচেনা, অজানা ডিবি পুলিশ, এখন নিপীড়িত মানুষের আশ্রয়স্থল। আপ্যায়ন করে, সেবার জগতে গণমূখী আখ্যা পেয়েছেন। এঁরা এতোটা বেরসিক হলো কেন? পরে নাকি চেয়ারম্যান মহোদয়কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছিলেন। প্রয়োজনে গ্রেপ্তার করবেন, সে ঘোষণাও দিয়েছিলেন। সুন্নতি লেবাসে যে লোকটি নিয়মিত নামাজ কালাম পড়েন, তাঁর সাথে এত নিষ্ঠুরতা কেন?
পি কে হালদার শত কোটি নিয়ে ভূস্বর্গ কানাডায়। ড্রাইভার মালেক টাকার বালিশে ঘুমায়। কেরানি আফজাল হাজার কোটি টাকা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় সাগর দেখে।! আর তাঁদের স্ত্রী, সন্তানদের কতই না বিলাসী জীবন। আর এদিকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রীকে গ্রেফতার করেই ক্ষান্ত হয়নি ডিবি। কড়ায় গন্ডায় হিসাব নিতে জাল পেতেছে চতুর্দিকে! এতো তৎপরতার হেতু কি? তদন্তে বেরিয়ে আসছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পাহাড় সমান জালিয়াতির খবর। ফাঁসের প্রশ্ন দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, চাকুরীর বাজারে মেধাবীদের পেছনে ফেলে জালিয়াতরা এগিয়ে যায়। এসব তো পুরণো খবর!! সবকিছুকে পেছনে ফেলে সামনে এখন কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। পরীক্ষা ছাড়াই সার্টিফিকেট! সিন্ডিকেটে শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান। নেতৃত্বে শিক্ষা বোর্ড প্রধানের স্ত্রী। বটবৃক্ষ হয়ে ছায়া দেন স্বয়ং শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান। এ যেন প্রযুক্তির যুগে জালিয়াতির আধুনিকায়ন! কি আজব কাজ কারবার!
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য তার শেষ কর্ম দিবসে ১৩৭ জনকে চাকরি দিলেন। বিধি-বিধান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেননি। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি একই পথ অবলম্বন করলেন। শেষ কর্ম দিবসে মা, মেয়ে মিলে চাকরির বাজার খুলে বসলেন। এখানে নাকি রীতিমতো দরদাম করে বেচা-কেনা হয়েছে! আবার টাকা দিয়েও অনেকে চাকরি পাননি, সে অভিযোগও আসছে। রাজশাহী আর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নিয়ে তো কত তুলকালামে হয়ে গেল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মা-ছেলে, স্বামী-স্ত্রী মিলে নিয়োগ বোর্ড হয়! এমনতর অভিযোগ আমাদের কে বিক্ষুব্ধ না করলে, জাতি হিসেবে তলিয়ে যাওয়ার বেশি বাকি নেই।
হবিগঞ্জ জেলার দুটো শতবর্ষ পুরণো ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছাতিয়ান বিশ্বনাথ উচ্চ বিদ্যালয় ও জগদীশপুর জেসি উচ্চ বিদ্যালয়। গত এক বছর যাবত ধারাবাহিকভাবে এ দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির শিরোনাম হচ্ছে। সাংবাদিকরা লিখলে কি বা আসে যায়! জেলার শিক্ষা প্রশাসনে বসা বড়কর্তা বড় আয়েশি মানুষ। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয়ের সাথে বেশভূষা, চলনে-বলনে দারুণ মিল। তাই সহজে কিছু হওয়ার নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা কমিটিতে ‘বিদ্যুৎসাহী’ সদস্য হিসেবে একটি পদ আছে। এ পদটির দারুণ ক্ষমতা। বিদ্যুৎসাহীর বিদ্যুতে সব পুড়ে ছাড়খার হয়ে যায়।
ভুয়া কোম্পানিতে হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ হয়। আলাউদ্দিনের চেরাগে হাজার কোটি টাকার মালিক হয় সরকারি কর্তা! এসব আমার গায়ে সয়ে যায়! শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর শিক্ষা প্রশাসনের কাজ কারবার সইতে পারিনা কেন?
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অ্যানালিস্ট এর ভাষ্যমতে, পাঁচ হাজার লোকের হাতে এখন নকল সার্টিফিকেট। ক'দিন বাদে এরা দেশ চালাবে!! দুর্নীতির রঙ্গ রস দিয়ে যাদের জীবনটা শুরু, এরা লুটেপুটে খেলে দোষ কোথায়?
কিছুদিন যাবত বেনজির কাণ্ডে দেশ উতাল পাতাল। কি জানি! হিসেবে কোথায় গড়মিল হলো? ক’বছর যাবত দেশবাসী অনবরত শুনেছে, নজির বিহীন বেনজির, পুলিশ বাহিনীর আদর্শ। চারবার যে লোকটি রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার পেল, হঠাৎ কোথায় গোলমাল হলো কিছুই বুঝতে পারছি না। বেচারা দেশান্তরি! সহায় সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে। দুদক সিংহের শক্তিতে ঝাপিয়ে পড়ছে মহা শক্তিমান মানুষটির উপর। এ যেন নজিরের উপর আরেক বেনজির! এরই মাঝে ঈদকে সামনে রেখে ছাগল কাণ্ডে বেসামাল অবস্থা! এনবিআর এর ক্ষমতাধর কর্মকর্তার সহায় সম্পদ দেখে চোখ ঝলসে যাওয়ার মতো কাজ কারবার। চারবার দায় মুক্তি পেলেও, এবার বোধহয় বেচারা ফেঁসেই যাবেন। বেনামি কোম্পানিতে হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ! এসব তো বাসি খবর। গরিবের ব্যাংক পোস্ট অফিস। সেখানেও হামলে পড়েছে হায়েনার দল। সঞ্চয়ের ৫৫ কোটি টাকা গায়েব!
ক্ষমতাধর প্রশাসক, পোষাকি আমলা, শিক্ষা কর্মকর্তা, আর আমাদের বিভিন্ন সেক্টরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথাকথিত রত্নদের মাঝে দারুণ মিল। এদের সবার হাতেই শুদ্ধাচারের সনদ! মসজিদ, মন্দিরে দান করেন দু'হাত ভরে। এরা সুযোগ পেলেই ওমরাহ করতে পশ্চিমে যান, কেউ বা ছুটে গয়া-খাসি! ফিরে এসে নতুন রূপে নেমে পড়েন একই কাজে। কোনভাবেই এরা সমাজ ও রাষ্ট্রে সংখ্যাধিক্য নয়! তবে দারুণ ক্ষমতাধর!! আবার রাষ্ট্রের ছায়াটি সরে গেলে, এরা বড়ই দীনহীন। এদের মধুচন্দ্রিমায় আঘাত না হলে সোনার বাংলা শ্মশান হবে। কোথায়, কখন কাকে থামাতে হবে বঙ্গবন্ধু কন্যা সেটি ভালো করেই জানেন। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে ম্যাসিভ অপারেশন অনিবার্য। জাতি সেই শুভক্ষণের অপেক্ষায়। শুদ্ধি অভিযানটি বাঁধাহীন হোক। অনৈতিকতার বিরুদ্ধে নৈতিকতা বিজয়ী না হলে মূল্যবোধের চর্চা থেমে যাবে, পরাভূত হবে সামাজিক শিষ্টাচার। অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে সমাজ, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হবে সুদূর পরাহুত।
লেখক: কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
ই-মেইল : [email protected]
Comments