আজ আন্তর্জাতিক খনি নিরাপত্তা দিবস ২০২৪। খনি শ্রমিকের জীবননিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশে প্রতি বছরই ৪ এপ্রিল এই দিবসটি পালিত হয়। তবে বিশ্বজুড়ে এখনো নিরাপত্তাহীনতায় কাজ করে যাচ্ছেন খনি শ্রমিকরা। এখনো প্রতিবছর মাটির নিচে খনি আরোহণ করতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন হাজারো শ্রমিক।
এশিয়াতে এই মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। বিশেষ করে কয়লা খনিতে কাজ করা শ্রমিকের মুত্যু সংখ্যা বেশি। হাজার বছর আগে থেকে খনির সম্পদ ব্যবহার করে মানুষ তার জীবন যাত্রাকে এগিয়ে নিয়েছে। তবে খনি শ্রমিকের দুর্দশা এখনও কাটেনি। নিরাপত্তার সঙ্গে বেশিরভাগ খনি শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পান না বলেও অভিযোগ আছে।
খনিজ সম্পদ এবং খনি শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সচেতনতার জন্য এই দিবস পালন করা হয়। সাধারণত খনিতে হঠাৎ ধ্বস এবং খনির মধ্যে বিষাক্ত গ্যাস বের হয়ে সেখানে কর্তব্যরতদের মৃত্যু হয়। এজন্য খনিতে খুব সর্তকতার সঙ্গে কাজ করতে হয়। খনিতে কাজ করার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়।
উল্লেখ্য, পৃথিবীর সব খনিতে নামার আগে তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয় বলে স্বাক্ষর করে নামতে হয়। অর্থাৎ সার্বক্ষনিক ঝুঁকি নিয়েই খনিতে কাজ করতে হয়।
পৃথিবীতে মাটির নিচে নেমে কয়লা খনিতে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করে। কয়লা খনির সংখ্যাও অনেক বেশি। এছাড়া সোনা, তামা, পাথরের খনিতেও মাটির নিচে নেমে কাজ করতে হয়। তেল বা গ্যাস খনিতে প্রযুক্তিগত কারণে মাটির নিচে মানুষ যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। মাটির নিচ থেকে তুলে যত শক্তি মানুষ ব্যবহার করে তারমধ্যে কয়লা অন্যতম।
প্রতিবছর হাজারও শ্রমিক খনিতে কাজ করতে গিয়ে মারা যায়। হঠাৎ বিষাক্ত গ্যাস বের হওয়া কিংবা খনি ধ্বসে এসব শ্রমিকের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশের খনিতে এখন পর্যন্ত বড় ধরণের কোনো দুর্ঘটনা হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। ২০১৩ সালের ২৬ মার্চ বড়পুকুরিয়া খনিতে কাজ করতে গিয়ে বিষাক্ত গ্যাসের কারণে কেকসি (৪৮) নামে একজন চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু হয়েছিল।
খনিতে মৃত্যুর হার চীনে সবচেয়ে বেশি। ২০১৩ সালে কয়লা খনি দুর্ঘটনায় চীনে এক হাজার ৪৯জন মারা গেছেন। যা ২০১২ সালের চেয়ে ২৪ শতাংশ কম। ২০১২ ও ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে এক হাজার ৩৮৪ ও এক হাজার ৯৭৩ জন । তবে কোনো কোনো মানবাধিকার সংগঠন দাবি করেছে, কয়লা খনিতে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া শ্রমিকের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।
নিরাপত্তা নিশ্চিত না করার কারণে চীনে শ্রমিক মৃত্যু বেশি বলে সংবাদ মাধ্যমে জানানো হয়েছে। এএফপি’র এক খবরে বলা হয়েছে, প্রায়ই সেখানে নিরাপত্তা বিধি মানা হয়না। এছাড়া ভারত, তুরস্ক, পাকিস্তান, ইউক্রেন, মিয়ানমানসহ বিভিন্ন দেশে খনিতে কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
দীর্ঘদিন মানুষ খনি থেকে সম্পদ তুলছে। সোয়াজিল্যান্ডের ‘লায়ন কেভ’ হল প্রত্নতত্ববিদদের খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে পুরোন খনি। এখানে করা রেডিওকার্বন ডেটিং অনুসারে এই খনিটি প্রায় ৪৩ হাজার বছর পুরোন। প্রাচীন প্যালিওলেথিক মানুষেরা এই খনি থেকে লোহা সমৃদ্ধ হেমাটাইট উত্তোলন করত।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) ১৯৮৫ সালে দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়াাতে, ১৯৮৯ সালে রংপুর জেলার খালাশপীর এবং ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরের দীঘিপাড়ায় কয়লা খনি আবিষ্কার করে। বর্তমানে বাংলাদেশে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি ও মধ্যপাড়া কঠিনশীলা খনিতে মাটির নিচে শ্রমিক কাজ করছে।
প্রাচীন রোমানরা খনি প্রকৌশলে নতুন যুগের সূচনা করেন। তারা বড় পরিসরে খনিজ পদার্থ উত্তোলনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। যার মধ্যে হাইড্রোলিক মাইনিং এর জন্য অসংখ্য নালার মাধ্যমে বিপুল পানি আনার পদ্ধতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কিছু খনিতে আবার রোমানরা পানি চালিত ঘূর্ণায়মান চাকার মতো কিছু যন্ত্রের প্রচলন করে যা হেক্সনের রিও টিন্টোর তামার খনিতে ব্যবহার হত। ১৬২৭ সালে হাঙ্গেরী রাজ্যের (বর্তমান স্লাভোকিয়া) এক খনিতে প্রথম বারুদ ব্যবহার হয়। শিল্প বিপ্লব খনি প্রকৌশলকে বেশি এগিয়ে দিয়েছে। উন্নত বিস্ফোরক, বাষ্পচালিত পাম্প, খনন পদ্ধতিকে আধুনিক করেছে।
পরিশেষে বলতে চাই, খনি শ্রমিকদের কথাই ধরা যাক। খনি থেকে উত্তোলন করা সম্পদে দেশ ও জাতির উন্নয়ন ঘটলেও খনি শ্রমিকদের জীবনমান এখনো তলানিতে। যারা জীবন বাজি রেখে খনিজসম্পদ উত্তোলন করতে গিয়ে পঙ্গত্ব বরণ করেন কিংবা নিহত হন, তাদের জীবনের নিরাপত্তা আজও নিশ্চিত করা যায়নি। নিরাপত্তাহীনতা আর জীবনের ঝুঁকি নিয়েই প্রতিদিন খনিজসম্পদ আহরণ করতে হয় তাদের। এতে হরহামেশা প্রাণ হারান কিংবা পঙ্গুত্ববরণ করেন অনেক শ্রমিক।খনির মতোই মূল্যবান খনি শ্রমিকদের জীবন। খনন পদ্ধতিকে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। খনি প্রকৌশলে উন্নত বিস্ফোরক, বাষ্পচালিত পাম্প ইত্যাদির প্রয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। যারা জীবনের বিনিময়ে দেশের জন্য সাফল্য বয়ে নিয়ে আসেন, দেশেকেই তাদের সুরক্ষা নিশ্চিতে সবাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে।আর পৃথিবীর সকল খনিতে নামার আগে তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয় বলে স্বাক্ষর করে নামতে হয়। অর্থাৎ সার্বক্ষণিক ঝুঁকি নিয়েই খনিতে কাজ করতে হয়।তাই খনিশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উন্নত বিস্ফোরক, বাষ্পচালিত পাম্প, খনন পদ্ধতিকে আধুনিকায়ন করার পাশাপাশি খনি শ্রমিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক,কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
Comments