রমজান উপলক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো চাঙ্গা হয়ে ওঠে। রমজান মাসজুড়ে ইফতার পার্টির মাধ্যমে দলীয় রাজনীতি চাঙ্গা করার পাশাপাশি মানুষের দৃস্টি আকর্ষণের কৌশল নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তারা নামিদামি হোটেল, রেস্তোরাঁ ও কমিউনিটি সেন্টার বুকিং দিয়ে বিশাল ইফতার পার্টির আয়োজন করে। তবে এবার কিছুটা ভিন্ন। কিছুদিন আগে শেষ হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।সেই নির্বাচন বর্জন করে সরকার পতনের আন্দোলন ডাক দিয়েছিল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, আবার সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন ’বয়কটের’ ডাক দিয়ে ব্যর্থ বিএনপি এখন ইফতার মাহফিলের নামে দলটির নেতা কর্মীদের চাঙ্গা করতে চাইছে। কিন্তু বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার এই সময়ে কম আয়ের মানুষের জন্য কোনো কর্মসূচি নেই। অথচ রোজায় ‘মানবসেবা’মূলক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটি এবার পুরো রোজায় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দরিদ্রদের মধ্যে ইফতারসামগ্রী বিতরণ করছে। রোজার শেষ সপ্তাহে ঈদসামগ্রীও বিতরণ করা হবে।
রমজানে বিএনপির ইফতার রাজনীতি
মঙ্গলবার রোজা শুরুর দিনে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নানা স্তরে পাঁচশ’র বেশি ইফতার আয়োজন করেছে বিএনপি। এইদিনেই রাজধানীর ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে এ ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এবং দলের সিনিয়র নেতারা এতিম, আলেম ও ওলামা মাশায়েখদের সঙ্গে নিয়ে ইফতার করেন। সেখানে মেন্যু হিসেবে ছিল- খেজুর, ফল, পেয়াজু, বেগুনি, ছোলা, জিলাপি, জুস, ডিমসহ মোরগ পোলাও রোজার মাসে রাজপথে তেমন কোনো কর্মসূচি না থাকলেও ইফতার ‘পার্টি’র নামে কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন বিএনপি। বিএনপির নেতারা মনে করছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বিএনপিতে নানামুখী সংকটের কারণে সৃষ্ট ক্ষোভ ও হতাশা কাটিয়ে ইফতার মাহফিলের মাধ্যমে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে চান তারা।
গেল ১২ মার্চে ঢাকার ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে বিএনপির ইফতার পার্টি। কাচ্চি বিরিয়ানির পাশাপাশি ৬-৭ পদের আইটেম দিয়ে অনুষ্ঠিত ওই ইফতার পার্টিতে দেখা গেল পাকিস্তানি ব্র্যান্ড ‘সেজান’ জ্যুস। অথচ গত ১১ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ জনগণের জন্য সস্তা খাবার বরাদ্দ রেখে নিজেরা ‘দামি ফল, খেজুর, আঙুর’ খাবে।’ আর বাস্তবতা হলো, ঢাকার ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে বিএনপির ইফতার পার্টিতেই দেখা মিললো দামী খেজুরের।
রমজানে আওয়ামী লীগের কৃচ্ছ্রতা সাধন
অসহায়-ছিন্নমূল ও গরীব মানুষের কথা চিন্তা করে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি বাসভবন গণভবনে কোনো ইফতারের আয়োজন না করার কথা রোজা শুরুর আগেই জানিয়েছেন। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ইফতার মাহফিল না করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দলীয়প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগ এবার তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কোথাও ইফতার মাহফিল না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ইফতার আয়োজনের সকল অর্থ অসহায়-গরিব মানুষের মাঝে সহায়তা হিসেবে প্রদান করবে।
রমজানে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা রমজান ইফতার পার্টি করতাম। এবার রমজানে আমরা ইফতার পার্টির না করে সব টাকা ও খাদ্য সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা মানুষের জন্য কাজ করি। মানুষের কল্যাণে কাজ করি।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন দলের নেতারা। তারা মনে করছেন, এতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে আওয়ামী লীগ সরকারের ইতিবাচক ভাবমূর্তি বাড়াবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘পবিত্র রমজান মাসে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলো কোন ইফতার মাহফিলের আয়োজন করবেন না। সেই টাকা দিয়ে দরিদ্র মানুষের মাঝে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করবেন।’তিনি আরও বলেন, ‘রমজান সংযমের মাস। রমজান মাসে কর্মসূচি চলমান রাখার ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিএনপি জনগণের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুভূতির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। তারা দেশের জনগণকে কোনোভাবেই স্বস্তিতে থাকতে দিতে চায় না। আমরা আগেই বলেছি, রমজানে ঘোষিত কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিএনপি আরও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।’
পবিত্র রমজান উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক কাজে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সারাদেশের নেতাকর্মীদের আটটি নির্দেশনা দিয়ে মাঠ থাকার নির্দেশ দিয়েছে সংগঠনটি। এরমধ্যে- শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী, অসহায় মানুষের মাঝে ইফতার ও সেহরি বিতরণ; বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ বিতরণ; রমজান মাসে স্বেচ্ছা রক্তদান ইত্যাদি। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ। সারাদেশে অসচ্ছল মানুষের মাঝে ইফতার সামগ্রী বিতরণের আয়োজন করেছে সংগঠনটি।
রমজান সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ একটি মাস
রমজান মুসলিম জাতির কাছে সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। মহাগ্রন্থ আল-কোরআন অবতীর্ণ হওয়া, ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত সময়ও রমজান মাস। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের তৃতীয় স্তম্ভ রোজা। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন- 'আর তোমরা জমিনে বিপর্যয় ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করো না তার সংশোধনের পর এবং তাঁকে ডাক ভয় ও আশা নিয়ে। নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীলদের কাছাকাছি।' (সুরা আরাফ : আয়াত ৫৬)
রোজাদারদের পারস্পরিক সমবেদনা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে রমজান মাসের রোজার ভূমিকা অপরিসীম উল্লেখ করে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন বলেন, ‘একজন রোজাদার ব্যক্তি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে গরিব-দুঃখীদের অপরিমেয় দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করতে শেখার মধ্য দিয়ে সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন ও তাদের জন্য সেহরি ও ইফতারের ব্যবস্থা করেন এবং তাদের দান-খয়রাত, জাকাত-সাদকা প্রদানসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেন।’
নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের বাস এই প্রিয় বাংলাদেশে। মাহে রমজানে সমাজের স্থিতিশীলতা, শান্তি, সম্প্রীতির সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিদ্যমান। সমাজের প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষ যদি মাহে রমজানের মতো অন্যান্য মাসেও আত্মসংযমের সঙ্গে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব ধরনের বিরোধ এড়িয়ে যান, তাহলে কোনো রকম সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না। তাই সমাজ-জীবনে পরস্পরের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের জন্য ভূমিকা অনস্বীকার্য।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী
Comments