বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪
Thursday, 21 November, 2024

অবশেষে পরিবার খুঁজে পেলেন সৌদি ফেরত সেই বৃদ্ধ প্রবাসী

দীর্ঘ ২৫ বছর পর বাবার সঙ্গে সন্তানদের দেখা, ব্র্যাকের মাধ্যমে পরিবারের কাছে হস্তান্তর
নিজসব প্রতিবেদক
  18 Jan 2023, 18:05
গতকাল বুধবার বিকেলে বৃদ্ধ আবুল কাশেমকে তাঁর পুত্র ও কন্যাসহ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান ছবিঃ ব্র্যাক

এ যেন নাটক-সিনেমার কোন দৃশ্য! দীর্ঘ ২৫ বছর পর বাবার সঙ্গে সন্তানদের দেখা। দেশে ফেরার পর যে মানুষটি পরিবারই খুঁজে পাচ্ছিলেন না অবশেষে চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকায় তাঁর পরিবারের সন্ধান মিললো। চট্টগ্রাম থেকে গতকাল বুধবার তাঁরা ঢাকায় এসে পৌঁছান। এরপর বিকেলে আবুল কাশেম নামের ওই বৃদ্ধকে তাঁর পুত্র ও কণ্যাসহ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান। বিকেলে তাঁরা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

এ সময় এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউল হক, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক স্কোয়াড্রন লিডার মোঃ রাসেল তালুকদার, সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল হান্নান রনি এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক মোঃ ফখরুল আলম উপস্থিত ছিলেন।

গত শুক্রবার দিবাগত রাতে সৌদি আরব থেকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছিলেন এই বৃদ্ধ। কিন্তু তিনি নিজের ঠিকানা বলতে পারছিলেন না। তাঁর কাছে পাসপোর্টও ছিলো না। অনেক কিছু ভুলে গিয়েছেন। এরপর বিমাবন্দরের পুলিশ তাকে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে পাঠায়। তাঁর খোঁজ পেতে ব্র্যাকের কর্মীরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজখবর শুরু করে। গণমাধ্যমেও বিষয়টি জানানো হয়। এরপর চট্টগ্রামের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়রের সহায়তায় তাঁর পরিবারের সন্ধান মেলে।

হস্তান্তরের আগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান জানান, বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশসহ সবার সহযোগিতায় বিদেশফেরতদের জন্য আমরা নানান ধরনের সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। এরই অংশ হিসেবে বিমানবন্দরের এভিয়েশন সিকিউরিটি ও মাইগ্রেশন পুলিশ শনিবার বিকেলে ওই বৃদ্ধকে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের কাছে দেন। ইমিগ্রেশন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী এই বৃদ্ধ সম্ভবত শুক্রবার দিবাগত রাতে জেদ্দা থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছেন। তাঁর কাছে কোন পাসপোর্ট ছিল না। তিনি ট্রাভেল পাস নিয়ে এসেছেন।

শরিফুল হাসান জানান শারিরীকভাবে সুস্থ মনে হলেও সম্ভবত তিনি ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত। এ কারণেই তিনি সঠিকভাবে তাঁর ঠিকানা বলতে পারছেন না। তিনি জানাচ্ছেন তাঁর নাম আবুল কাশেম। পিতার নাম ফজেল আহমেদ। মাতা সাবানা। স্ত্রীর নাম বলছেন আমেনা। নিজের ঠিকানা তিনি কখনো বলছেন চট্টগ্রামের নয়াবাজার। কখনো বলছেন টেকনাফ। আবার কখনো রাউজানের পাহাড়তলী ইউনিয়নের গরিশংকরহাটের কথাও বলছেন। আবার বলছেন, চট্টগ্রামের নতুন বাজার হালিশহরের কাছে, ঈদগাহের মাঠ বউ বাজার এলাকায় তাঁর ছেলের তরকারির দোকান আছে। আমরা তাঁর বাড়ি কোথায় নিশ্চিত হতে না পারলেও ভাষা শুনে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম তার বাড়ি চট্টগ্রাম অঞ্চলে।

আবুল কাশেম দাবি করছিলেন, তাঁর ৬ মেয়ে ও ৩ ছেলে রয়েছে। তাঁর তিন ছেলের নাম মান্নান, নূর হাসান, এনামুল হাসান। এর মধ্যে নূর হাসানের তরকারির দোকান আছে। ছোট ছেলে এনামুল হাসান দুবাই থাকেন। মান্নান সৌদি থাকেন বলে দাবি তাঁর। ৮-১০ জন নাতি নাতনি আছেন। কিন্তু যেহেতু দীর্ঘ ২৫ বছর দেশে নেই সঠিকভাবে সব বলতে পারছিলেন না। তবে যেহেতু তিনি চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলছিলেন কাজেই  আমরা চট্টগ্রামের পুলিশসহ নানা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমরা তাঁর পরিবারের সন্ধানে গণমাধ্যম কর্মীদের সহায়তা চাই। অনেকেই তাঁর বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করেন। এরপরও আমরা পরিবারের সন্ধান পাচ্ছিলাম না।

শরিফুল হাসান জানান, ওই বৃদ্ধ কখনো চট্টগ্রামের হালিশহর, কখনো হাটহাজারী, নয়াবাজারসহ বেশ কিছু ঠিকানা বলছিলেন। তিনি যখন যেসব এলাকার কথা বলছিলেন আমাদের চট্টগ্রামের ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কর্মীরা সেসব এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিচ্ছিলেন। ওই বৃদ্ধ বলছিলেন চট্টগ্রামের নয়াবাজার এলাকায় তাঁর ছেলে তরকারি বিক্রি করে। সেই কথার উপর ভিত্তি করে আমাদের চট্টগ্রাম টীম "পরিবারের সন্ধান চাই" শিরোনামে ছবিসহ শত শত পোস্টার বিলি করে বেড়ায়। চট্টগ্রামের শহরের হালিশহর, নয়াবাজার, বউবাজার, ঈদগাহ, পাহাড়তলী সহ আরো বেশ কয়েকটি স্থানে দেয়ালে দেয়ালে আমরা পোস্টার লাগান। আমরা বিশ্বাস রেখেছিলাম গণমাধ্যমকর্মীসহ সবার সহযোগিতায় আমরা তাঁর পরিবারকে খুঁজে বের করবোই।

শরিফুল হাসান জানান, এসব পোস্টার দেয়ালে লাগানো ও বিতরণ করার পর মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রামের আমাদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র (২৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর) আব্দুস সবুর লিটন যোগাযোগ করেন। তিনি জানান, পোস্টারের ছবির লোকটিকে তিনি চিনতে পেরেছেন। এরপর আমাদের লোকজন তাঁর অফিসে যায়। তাঁর সহযোগিতায় আমরা তাঁর ছেলে সবজি ব্যবসায়ী জনাব নূর হাসানের খোঁজ পাই। পরবর্তীতে কাউন্সিলর অফিসে তাকে এনে কথা বলে জানতে পারি আবুল কাশেম তাঁর বাবা। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র দেখেও আমরা বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। নুর হাসানের কাছ থেকে আমরা পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলি। দুবাইতে থাকা তাঁর এক ছেলের সঙ্গেও কথা বলি। এরপর বৃদ্ধ আবুল কাশেমের ছোট মেয়ে রুমা বেগম ও তার স্ত্রী আমেনা বেগমের সাথে ঢাকা থেকে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দেই। এ সময় যে আবেগঘণ পরিবেশের সৃষ্টি হয় সেটি ভাষায় বলা কঠিন। এরপরই আমাদের লোকজনের সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা তাকে নিতে ঢাকায় রওয়ানা হন।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিদেশ ফেরত আবুল কাশেমের বড় ছেলে নূর হাসান। তিনি তার বাবাকে ফিরে পেয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ব্র্যাকসহ আপনাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা। অনেকদিন ধরে বাবার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল না। আমরা জানতাম না তিনি সৌদি আরবের কোথায় আছেন। তিনি যে দেশে এসেছেন সেটাও আমরা জানতাম না। পোস্টার দেখে ও স্থানীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে ব্র্যাকের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হেয়। আমরা তার পরিবারের সদস্য হয়েও যা করতে পারিনি ব্র্যাক আমার বাবার জন্য তার চেয়ে বেশি কিছু করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জনাব জিয়াউল হক বলেন, বাবা-সন্তানের দেখা হওয়ার যে দৃশ্য এটি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আমরা অনেকদিন ধরে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সাথে কাজ করছি। এই প্রবাসীকেও আমরা মানসিক ভারসাম্যহীণ অবস্থায় ব্র্যাকের কাছে দিয়েছিলাম।

স্কোয়াড্রন লিডার মোঃ রাসেল তালুকদার বলেন, ২৫ বছর পর নিজ দেশে ফেরত এসেছেন এমন একজন অভিবাসীকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। এমন ঘটনা আমরা সবসময় সিনেমাতেই দেখি, বাস্তবে এই প্রথম আমি ঘটনার স্বাক্ষী হলাম। বিমানবন্দরে এমন অনেক যাত্রীকেই আমরা পাই যারা মানসিক অসুস্থ্যতার কারণে কিছুটা স্মৃতিভ্রম থাকে। তারা কোথায় যাবেন না যাবেন সেটা বুঝতে পারেনা। সেই সময়টাতে আমরা ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে যোগাযোগ করে নিশ্চিন্তে থাকি। করোণাকালীন সময়েও তারা এসব ক্ষতিগ্রস্ত বিদেশফেরদের পাশে ছিলেন।

দীর্ঘদিন পর পরিবারকে পেয়ে আবুল কাশেম তাঁর সন্তানদের বারবার জড়িয়ে ধরছিলেন। তাঁকে নিতে আসা কন্যা পারভীন আক্তার বলেন, আমার বাবা যখন ২৫ বছর আগে সৌদি আরবে যায় অমার ছোট বোন রূমা তখন মায়ের পেটে। বাবার সঙ্গে আমাদের স্মৃতি খুব কম। আমরা এখন বাবাকে ফেরত পেলাম। আমাদের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।

 

 

Comments

  • Latest
  • Popular

নতুন প্রজন্মের চিন্তাধারা বুঝতে হবে: প্রধান উপদেষ্টা

সেন্টমার্টিন যেতে লাগবে ট্রাভেল পাস

বছরের শেষ ম্যাচে মেসির বিশ্বরেকর্ড

সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া

নতুন আইজিপি বাহারুল, ডিএমপি কমিশনার সাজ্জাদ

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিধান থাকছে না ট্রাইব্যুনাল আইনে

ভারতে দুই রাজ্যের নির্বাচন, জনপ্রিয়তার পরীক্ষায় মোদি

বাংলাদেশে বছরে ১২-১৮টি এলএনজি কার্গো রপ্তানির প্রস্তাব ব্রুনাইয়ের

গ্রেপ্তার দেখিয়ে সাবেক আইজিপিসহ আট কর্মকর্তাকে কারাগারে

তারেক রহমানের জন্মদিন

১০
বাংলাদেশে আরো বেশি সৌদি বিনিয়োগের আহ্বান ড. ইউনূসের
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সৌদি  আরবকে বাংলাদেশে আরো বেশি বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে একইসাথে
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালিদের সাথে মতবিনিময় / স্মার্ট সিটি গড়তে প্রবাসীদের সহযোগিতা চাইলেন মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম
স্মার্ট সিটি গড়তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থায় কর্মরত প্রবাসী বাঙালিদের সহযোগিতা চাইলেন ঢাকা
নিরাপদ ও নৈতিক অভিবাসন নিশ্চিত করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ -প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি বলেছেন, নিরাপদ ও নৈতিক অভিবাসন নিশ্চিত
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার প্রতিহত করতে প্রবাসীদের প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহবান
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে অপপ্রচার চালায়, দেশের শত্রুতা করে তাদের প্রতিহত করতে প্রবাসী
Error!: SQLSTATE[42S22]: Column not found: 1054 Unknown column 'parent_cat_type' in 'field list'