এখন যৌবন যার মিছিলে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ এই কালজয়ী পঙ্ক্তির রচয়িতা কবি হেলাল হাফিজ, যিনি প্রেম ও দ্রোহের কবি হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন।
শৈশব থেকে স্বাধীনতার প্রান্তর
হেলাল হাফিজের জীবনের গল্প এক বেদনা ও সংগ্রামের গল্প। ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোণার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামে জন্ম। শৈশবেই মায়ের মৃত্যু তার জীবনকে গভীর শূন্যতায় আচ্ছন্ন করে। নেত্রকোনা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ১৯৬৭ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তাল ষাটের দশক আর দেশের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী অগ্নিগর্ভ পরিবেশ তার কবিতার প্রধান উপাদান হয়ে ওঠে।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় লেখা তার ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি যেন মিছিলের প্রতিধ্বনিতে রূপ নেয়। তার কবিতার লাইন— “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়”— গণআন্দোলনের স্লোগান হয়ে ওঠে। এই কবিতাটি তাকে এনে দেয় অভূতপূর্ব খ্যাতি।
অলৌকিকভাবে বেঁচে ফেরা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান হেলাল হাফিজ। সেদিন নিজের হলে থাকলে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হতো। কারফিউ উঠে গেলে নিজের হলে ফিরে গিয়ে দেখেন ধ্বংসস্তূপ আর লাশের স্তূপ। এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তার জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সেই রাতে বেঁচে থাকার গল্পে মিশে আছে নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে তার ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ।
সাংবাদিকতা ও সৃজনশীল জীবন
স্বাধীনতার পর সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন হেলাল হাফিজ। ১৯৭২ সালে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর কাজ করেন দৈনিক দেশ এবং যুগান্তর-এ।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি তার কবিতা চর্চা চলতে থাকে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’ তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। গ্রন্থটি তুমুল সাড়া ফেলে এবং তার ৩৩টির বেশি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা ৭১’। তার তৃতীয় ও শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।
প্রেম ও দ্রোহের কবি
হেলাল হাফিজ প্রেম ও দ্রোহের চেতনায় সমৃদ্ধ কবিতা লিখে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেন। তার কবিতার গভীরতা ও সাহসিকতা বাংলাদেশি সাহিত্যের একটি অনন্য অধ্যায়। ব্যক্তিগত জীবনে বেদনা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিকূলতা তাকে এক নিভৃতচারী কবির জীবন বেছে নিতে বাধ্য করে।
শেষ দিনগুলো
জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি একান্তে কাটিয়েছেন। মহামারি করোনা শুরুর আগে থাকতেন সেগুনবাগিচার কর্ণফুলী হোটেলে। পরে প্রেস ক্লাবকেন্দ্রিক জীবন ছেড়ে ইস্কাটন এলাকায় ভাইয়ের বাসায় কিছুদিন কাটান। তবে শিগগিরই হোটেলকেন্দ্রিক জীবনে ফিরে যান।
হেলাল হাফিজের জীবন ছিল সংগ্রাম, প্রেম, দ্রোহ, এবং সৃষ্টিশীলতার এক অমূল্য উদাহরণ। তার কবিতাগুলো বাংলাদেশি সাহিত্যের ঐতিহ্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
Comments