আসাদগেট মোড়ে পঁয়ত্রিশ মিনিট যানজটে আটতে থাকার পর বাস থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করেন ফারুক সাহেব এবং কুড়ি মিনিট দৌড়ানোর পর প্রায় ছুটতে ছুটতেই অফিসে প্রবেশ করলেন। তার সদ্য ইস্ত্রি করা শার্টের বুক পিঠ ঘামে ভিজে শপশপা। আসাদগেট টু শুক্রাবাদ পথটা নেহায়েৎ কম নয়। হাঁপাতে হাঁপাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, নটা সতের। ধ্যাৎ! আজও সতের মিনিট লেট! এত দৌড়াদৌড়ি করেও কোনো লাভ হলো না।
ফারুক সাহেব ভুরুতে কয়েকটা গিঁট ফেলে চোয়াল শক্ত করে নিজের ডেস্কে বসলেন। মেজাজ খারাপ হলে তার ভুরুতে গিঁট পড়ে, চোয়ালও শক্ত হয়ে যায়। কেন এমন হয়, জানেন না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলেন, ছোটবেলার অভ্যেস। তিনি কম্পিউটারের পাওয়ার বোতামে চাপ দিয়ে টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজপত্র, ফাইল গোছগাছ করতে শুরু করেন। তারপর মোবাইল ফোনে আজকের টু ডু লিস্ট দেখতে দেখতে অনুভব করেন বুকের লোমের ভেতর দিয়ে ঘামের চোরাস্রোত সুরসুর করে নিচে নামতে নামতে নাভিতে প্রবেশ করছে। পিঠের দিকেও ঘামের রেখা নিম্নগামী হচ্ছে। ব্যাপার কি! অফিসে ঢোকার পর প্রায় পাঁচ সাত মিনিট হয়ে গেছে, এখন তো তার শরীর জুড়িয়ে যাওয়ার কথা। তারপরও ঘামছেন কেন? ফারুক সাহেব গিটযুক্ত ভুরু উত্তোলন করে ছাদের সিলিংয়ে সাঁটানো এসির দিকে তাকিয়ে দেখলেন লাল আলো জ্বলছে! ভুরুতে আরেকটা গিট পড়ল তার।
তিনি সোজা উঠে গিয়ে অদূরের ডেস্কে বসা সামির সাহেবের সামনে দাঁড়ালেন। সামির সাহেব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলেন। তার চোখ কম্পিউটারের মনিটরের দিকে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকাতেই ফারুক সাহেব বললেন, সামির ভাই, আপনিও তো ঘামছেন। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম, কপালে ঘাম, তারপরও এসিটা বন্ধ করে রেখেছেন কেন, একটু জানতে পারি?
সামির সাহেবের চেহারায় থতমত ভাব ফুঁটে উঠল। এমন ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। সুযোগ পেলেই সামির সাহেব এসি বন্ধ করে দেন। এই নিয়ে অফিসের সবাই প্রথম প্রথম হাসাহাসি করলেও এখন বিরক্ত। কোনো মানে হয়! চল্লিশ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রায় জ্যান্ত মানুষ গ্রিল হয়ে যাচ্ছে, সেখানে তিনি এসি বন্ধ করে রাখেন! কোনো মানে হয়! জিজ্ঞেস করলে আবার বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। উফ!
‘কী হলো, এরকম ক্যাবলার মতো তাকিয়ে আছেন কেন?’
সামির সাহেব কোনো উত্তর না দিয়ে এসির রিমোটটা এগিয়ে দেন। ফারুক সাহেব এসির রিমোট নিয়ে এসি চালু করে দিয়ে গজর গজর করতে করতে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসেন। মিন্টুউউউ...। হাঁক ছেড়ে অফিসের স্টাফ মিন্টু মিয়াকে ডাকেন। ‘চা দেওয়ার কথাও কি তোকে ডেকে বলতে হবে? সেই কখন অফিসে ঢুকেছি!’
২.
অফিস শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন ফারুক সাহেব। মিরপুর রোডের সেই চিরচেনা যানজট, পুরনো প্রেমিকার মতো, প্রতিদিন দেখলেও প্রতিদিন নতুন মনে হয়। বাস আটকা পড়ে আছে শ্যামলীর কাছাকাছি। অজস্র মানুষ ঢেউয়ের মতো হেঁটে যাচ্ছে ফুটপাত ধরে। ঢেউগুলো মাঝে মাঝে এঁকেবেঁকে যাচ্ছে, কারণ ফুটপাত নির্ঝঞ্জাট নয়। তা দখল করে আছে কাপড়ের হকার, জুতার ভ্যানওয়ালা, বেলুনের ফেরিওয়ালা। ফারুক সাহেব বাসের ভেতর জানালার পাশে বসে থেকে এইসব ঢেউ গুনছিলেন আর ঘামছিলেন। এত গরম নাকি গত সত্তুর বছরে পড়েনি! হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় রাস্তার পাশের এক ইলেকট্রনিক্সের শোরুমে। কাঁচঘেরা শোরুমের অন্দরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ফারুক সাহেব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন, একজন মানুষ শোরুমের ভেতরে সাজিয়ে রাখা এসির গায়ে হাত বুলাচ্ছেন!
বিক্রেতার সঙ্গে হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলছেন। বিক্রেতাও একটা ক্যাটালগ দেখিয়ে কি সব বোঝাচ্ছেন! ফারুক সাহেব বিশ্বাস করতে পারছে না, তিনি যাকে দেখছেন সেই মানুষটা স্বয়ং সামির সাহেব! অফিসের কেলেঙ্কারি রাস্তার শোরুম পর্যন্ত পৌঁছেছে দেখে তিনি আঁতকে উঠলেন। বাস থেকে নেমে গিয়ে সামির সাহেবকে উদ্ধার করবেন কিনা সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই যানজট ছুটে গেল। ফারুক সাহেবের বাস সামনে এগিয়ে গেল আর দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলেন সামির সাহেব।
পরদিন অফিসে পৌঁছুতে আর লেট হলো না ফারুক সাহেবের। ন’টার আগেই অফিসে পৌঁছে দেখেন আরেক কলিগ অন্তু সাহেব মাত্রই পৌঁছেছেন, কম্পিউটারের পাওয়ার অন করছেন। সামির সাহেব এখনো আসেননি। তবে তাদের একমাত্র নারী কলিগ বিপাশা ম্যাডাম এসেছেন। ফেসবুকে মুখ গুজে আছেন। কর্পোরেট এই অফিসের অ্যাকাউন্টস সেকশনে কাজ করেন তারা। প্রত্যেকের বয়সই পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের কোটায়। কেবল তাদের বস, অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার আনোয়ারুল্লাহ সাহেবের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। তিনি অবশ্য এগারোটা নাগাদ অফিসে আসেন।
সে যাই হোক, সামির সাহেবের অনুপস্থিতিতে অপর দুই সহকর্মীকে কাছে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হলেন ফারুক সাহেব। ‘এই যে শুনছেন! অন্তু ভাই-বিপাশা ম্যাডাম, শোনেন না কাল কী ঘটেছে।’ খুশি খুশি গলায় কলিগদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন ফারুক সাহেব। বিরাট কিছু আবিষ্কার করে ফেললে তার ফলাফল হাসিমুখে অন্যকে জানানোই নিয়ম। কিন্তু সবার আগে দৃষ্টি আকর্ষণে সাড়া দিল মিন্টু। তিনি কড়া নজরে মিন্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের জন্য চা বানিয়ে আন তো মিন্টু, যা।
বিপাশা ম্যাডাম ফেসবুক থেকে চোখ তুলে চেয়ার এগিয়ে নিয়ে এলেন ফারুক সাহেবের দিকে। অন্তু সাহেবও এগিয়ে এলেন। ফারুক সাহেব তখন ‘দেয়ালেরও কান আছে’ নীতি অবলম্বন করেন যতদূর সম্ভব গলা নীচু করে ফিসফিস করে বললেন, সামির সাহেব তো বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে!
‘বলেন কি!’ চোখ গোল গোল করে চাপা গলায় বিস্ময় প্রকাশ করেন বিপাশা ম্যাডাম। ‘কি হয়েছে বলেন তো? ছোট ছোট দুইটা ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাবি এখন কী করবে? আহারে! বলেন না, ফারুক ভাই, কী হয়েছে?’
‘আচ্ছা, বলছি বলছি শোনেন।’ গলা আরও নিচু করে কথা শুরু করেন ফারুক সাহেব। ‘কাল অফিস শেষ করে বাসায় যাচ্ছিলাম। জানেন তো আমার বাসা মিরপুর এক নম্বরে। বিহঙ্গ বাসে যাচ্ছি। আর এই শহরের জ্যামের কথা তো নতুন করে বলার কিছু নাই। বাস জ্যামে আটকে আছে শ্যামলীর ওখানে। তো ওখানে একটা ইলেকট্রনিক্সের শোরুম আছে না? হঠাৎ দেখি ওই শোরুমের ভেতর সামির সাহেব। এসি দেখছেন! আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম!’ তারপর গত বিকেলের ঘটনা আদ্যোপান্ত রসিয়ে রসিয়ে বয়ান করেন ফারুক সাহেব। শেষে চিন্তিত মুখে বলেন, শোরুমের এসি বন্ধ করতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন বোধহয়। কী কেলেঙ্কারি দেখেন তো!
সব শুনে অন্তু সাহেব বললেন, ‘আরে নাহ! ধরা খাবেন কেন? বাসার জন্য এসি কিনবেন হয়ত, তাই দামদর জানতে গিয়েছিলেন।’
‘এই যে, এইইই যে...।’ সুর করে বলেন ফারুক সাহেব। ‘আপনার মাথায় যে জৈবসার ব্যতিরেকে অন্যকিছু নেই তা আবার প্রমাণ করলেন। যে লোক সারাক্ষণ অফিসে এসি বন্ধ রাখে সেই লোক যাবে এসি কিনতে? কোন লজিকে আপনার মাথায় এই চিন্তা এলো বলেন তো?’
অন্তু সাহেব প্রতিউত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই বিপাশা ম্যাডাম বললেন, ‘কিন্তু এই কারণে আপনি সামির ভাইকে বদ্ধ উন্মাদ বলতে পারেন না। হয়ত এসি না, ভাবির জন্য ওয়াশিং মেশিন কিনতে গিয়েছিলেন।’
অন্তু সাহেব বললেন, ‘টিভির রিমোটও হতে পারে। হয়ত বাসার টিভির রিমোট নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি রিমোট কিনতে গেছেন, হতে পারে না?’
‘আপনাদের মাথা আসলেই গোবরে ভর্তি।’ সহকর্মীদের নির্বুদ্ধিতায় বিরক্ত হয়ে ফারুক সাহেব বললেন, ‘আমি স্পষ্ট দেখলাম, এসি এসি। এসির গায়ে হাত বুলাচ্ছেন। ওদের সেলসম্যানের সঙ্গে বাকবিতন্ডা হচ্ছে।’
চায়ের কাপের টুংটাং আওয়াজ শোনা গেল। মিন্টু চা নিয়ে এসেছে। ফারুক সাহেব, অন্তু সাহেব, বিপাশা ম্যাডাম যে যার ডেস্কে গিয়ে বসলেন। কাজের লোকের সামনে পারিবারিক কথা বলতে নেই থিউরি অফিসেও প্রয়োগ করছেন তারা।
৩.
সামির সাহেব যে বাসায় ভাড়া থাকেন সেটি টিনশেড। সারা দিনের সূর্যের তাপ নিয়ে আগুনের চুল্লি হয়ে থাকে ঘরটা। রাতে টিনের চাল হয়ে যায় সিনেমার ড্রাগন, যেন হা করে উগরে দেয় আগুনের হল্কা। সিলিংয়ের সঙ্গে একটি ফ্যান অবশ্য লাগিয়েছেন সামির সাহেব। মাথার ওপর ঘরঘর আওয়াজ তুলে ঘুরতে থাকে সারাক্ষণ। তবু রাতে পাঁচ বছর বয়সী ছেলে আর আট বছর বয়সী মেয়েকে পাশে নিয়ে শুয়ে শুয়ে হাত পাখার বাতাস করেন সামির সাহেব। মেয়েটা প্রশ্ন করে, ফ্যান তো ঘুরছে, বাবা। তুমি হাতপাখা ঘুরাচ্ছ কেন?
সামির সাহেব হাসেন। মেয়ের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলেন, এমনিতেই মা। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আমি যখন ছোট ছিলাম তোমাদের মতো, তখন প্রথম আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ আসে। আমাদের বাড়িটাও ছিল টিনের। খুব গরম হতো। তখন আমার আব্বা, মানে তোমাদের দাদু ভাইয়ের ফ্যান কেনার সামর্থ ছিল না। তাই...
‘সামর্থ কী বাবা?’
‘সামর্থ মানে ধরো যে ক্ষমতা। ধরো যে তোমার আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করল। তো আইসক্রিম কিনতে কী লাগবে? টাকা লাগবে। এখন তোমার কাছে যদি টাকা না থাকে, তার মানে হচ্ছে তোমার সামর্থ নাই। বুঝেছ, বাবা?’
‘ও...। তারমানে দাদুর টাকা ছিল না।’
‘একজ্যাক্টলি। তো তোমাদের দাদু ভাই তখন কী করত, জানো? আমাদের দুই ভাইকে এভাবে শুয়ে রেখে সারা রাত হাত পাখার বাতাস করত। আমরা তখন ঘুমাতাম।’
‘দাদু ঘুমাত না?’
‘তোমাদের দাদুর এক বিরল প্রতিভা ছিল। সে ঘুমের মধ্যেও পাখা ঘুরাতে পারত। আমাদের পাশে শুয়ে ঘুমাত কিন্তু তার হাত ঘুরত ঠিকই।’
‘বাবা, বিরল প্রতিভা কী?’
‘প্রতিভা মানে হচ্ছে গুণ। এই যে তুমি কাগজ দিয়ে পাখি বানাতে পারো, এটা তো সবাই পারে না। তারমানে এটা তোমার একটা বিরল প্রতিভা। যে গুণ সবার মধ্যে থাকে না, সেটা যদি কারো মধ্যে থাকে, তাহলে সেটাকে বলা হয় বিরল প্রতিভা। ঠিক আছে?’
‘হুমম। বুঝেছি।’
‘এখন ঘুমাও মা। আমি বাতাস করছি।’
সামির সাহেব এক হাতে পাখা ঘুরাতে থাকেন আর আরেক হাতে একবার ছেলের মাথার চুলে একবার মেয়ের মাথার চুলে বিলি কাটতে থাকেন। বাচ্চা দুটো আরামে ঘুমের অতলে ডুবে যায়। সামির সাহেব মনে মনে বলেন, তোরা বুঝবি না রে মা, কেন আমি পাখা ঘুরাই। আমি আমার আব্বার কষ্টটা বোঝার চেষ্টা করি। আমাদেরকে মানুষ করতে গিয়ে কত কষ্টটাই না করেছে। অথচ কি কপাল! যখন ছেলেরা চাকরি পেল, একটু শান্তিতে তার অবসর যাপনের সময় এলো, তখনই কিনা হুট করে মরে গেল লোকটা!
একটা কান্নার পিন্ড বুক থেকে উঠে এসে গলায় আটকে গেল সামির সাহেবের। তিনি জোরে জোরে পাখা ঘুরাতে লাগলেন। এরমধ্যে রান্নাঘর গোছগাছ করে এসে বাচ্চাদের পাশে শুয়ে পড়ে সামির সাহেবের স্ত্রী। সামির সাহেব বলেন, ‘দিনের বেলা তোমাদের খুব কষ্ট হয়, তাই না? যা গরম পড়েছে। সত্তুর বছরের ইতিহাসে নাকি এরকম গরম পড়েনি।’ সামির সাহেবের স্ত্রী কোনো কথা বলেন না। কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর সামির সাহেব আবার বলেন, স্বপ্না, শুনছ? স্বপ্না...।
‘সারাদিন গাধার খাটুনির পর রাতের বেলা পিরিতের আলাপ করতে ভাল্লাগে না। ঘুমাও তো।’
সামির সাহেব আর কোনো কথা বলেন না। নিঃশব্দে হাতপাখা ঘুরাতে থাকেন।
৪.
অফিসে আজও হট্টগোল। ফারুক সাহেব উত্তপ্ত গলায় বলছেন, না, না, এভাবে তো অফিস করা সম্ভব নয়। অফিসের পরিবেশ যদি কমফোর্টেবল না হয় তাহলে কাজ করব কী করে?
অন্তু সাহেবের গলা অতটা উত্তপ্ত না হলেও তিনিও মৃদু কণ্ঠে সায় দিলেন, ‘কথা তো ঠিকই। সুযোগ পেলেই ভদ্রলোক এসি অফ করে দেন। আমাদেরকে আবার এসি অন করতে হয়। তিনি আবার বন্ধ করেন। আমাদেরকে আবার অন করতে হয়। এই অন অফ খেলা যদি সারাক্ষণ চলতেই থাকে তাহলে অন্য কাজ করব কখন?’
‘না, না। এর একটা বিহিত করতেই হবে। ম্যানেজার স্যার এলে আজকেই বলতে হবে ব্যাপারটা। কী বলেন আপনি?’
অন্তু সাহেব উত্তর না দিয়ে সামির সাহেবের দিকে তাকান। ধরা পড়া চোরের মতো মাথা নিচু করে বসে অছেন সামির সাহেব। বিপাশা ম্যাডাম তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। ‘কি হয়েছে আপনার সামির ভাই বলেন তো। আপনি কেন এসি অফ করে দেন? আপনার কি শীত করে? অসুস্থবোধ হয়? আপনার শার্ট তো দেখা যায় ঘামে ভেজা। কপালে ঘাম চিকচিক করছে! সামির ভাই, বলেন না, কি হয়েছে? আমরা তো একটা ফ্যামিলির মতোই তাই না। একটু খুলে বলেন না, প্লিজ, কী সমস্যা হচ্ছে আপনার?’
সামির সাহেব মাথা নিচু করেই থাকেন। মাঝে মাঝে চোখ তুলে অসহায়ের মতো তাকান। তারপর আবার মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মেঝেতে অদৃশ্য আঁকিবুকি কাটেন।
৫.
এরপর একদিন হট্টগোল পড়ে গেল সামির সাহেবের ছোট্ট টিন শেডের বাসাতেও।
বিকেল গড়ানোর আগেই অফিস থেকে বাসায় ফিরেছেন সামির সাহেব। প্রকৃতিতে সূর্যের আলো তখনও চব্বিশ ক্যারেটের স্বর্ণের মতো চকচক করছে। মাথায় করে কী একটা বড় বাকশোর মতো জিনিস নিয়ে বাসায় ঢুকেছেন সামির সাহেব। তার কানের দু’পাশের জুলফি গড়িয়ে ঘাম পড়ছে। মুখে অমলিন হাসি।
দৃশ্য দেখে সামির সাহেবের স্ত্রীর চোখ চড়ক গাছ! তিনি হা হা রে রে করে উঠলেন। ‘টিনশেড বাসায় তুমি এসি লাগাবা? বদ্ধ উন্মাদ না হলে কেউ এ কাজ করে? এটা কী তোমার নিজের বাসা? থাকো তো ভাড়া বাসায়। মাস শেষে ঠিকমতো কারেন্ট বিলই দিতে পারো না। তুমি এসি কেনার টাকা পাইলা কই?’
হইচই শুনে বাচ্চারা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারা অবশ্য ভীষণ খুশি।
স্ত্রীর গালিগালাজ অগ্রাহ্য করে সামির সাহেব আবার বেরিয়ে পড়েন। এসি লাগানোর মিস্ত্রি খুঁজতে হবে।
চারপাশ ভেসে যাচ্ছে স্বর্ণালী রোদে। খানিক আগে মনে হয় কোনো ভিআইপি গেছেন এই পথ দিয়ে। যাওয়ার সময় সমস্ত যানজটকে খেদিয়ে নিয়ে গেছেন। রাস্তা তাই মাত্রাতিরিক্ত ফাঁকা। ফাঁকা রাস্তার সুবিধা নিচ্ছে বাস চালকরা। সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে গাড়িগুলো। গাড়িগুলো যাওয়ার পর রাস্তার ধুলো এসে লেপ্টে যাচ্ছে ফুটপাতের হেঁটে যাওয়া ঘর্মাক্ত মানুষগুলোর শরীরে। ভ্যাপসা গরম। কতদিন বৃষ্টির ছোঁয়া পায়নি এ শহর! আহারে! রুক্ষ শহরের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সামির সাহেব মনে মনে কথা বলেন, ‘তুমি তো জানো না স্বপ্না, তোমাদের জন্য আমার কত কষ্ট হয়। তোমরা সারাদিন বাসায় গরমের মধ্যে কষ্ট পাও। টিনের চাল তেতে থাকে। বাচ্চা দুটো ছটফট করে গরমে। আর আমি অফিসে সারাদিন এসির মধ্যে বসে থাকি। আমার ভালো লাগে না স্বপ্না। চোখের সামনে ভেসে ওঠে তোমার মুখ। গরমে ঘেমে চুলার সামনে দাঁড়িয়ে রান্না করছ তুমি, আগুনের আঁচে লাল হয়ে গেছে তোমার মুখ, টপটপ করে ঘাম পড়ছে নাকের ডগা দিয়ে। আমি আর স্থির থাকতে পারি না। আমার বাচ্চারা, আমার তিলু বিলু গরমে হাঁসফাস করছে আর আমি বসে আছি ঠাণ্ডা শীতল ঘরে। অফিসের ঠাণ্ডা আরাম আমার গলা টিপে ধরে। আমি শ্বাস নিতে পারি না। আমার গিলটি ফিল হয়। তড়িঘড়ি উঠে গিয়ে এসি
বন্ধ করে দেই। এ নিয়ে অফিসে যা-তা অবস্থা। কলিগরা হাসাহাসি করে। আমি কাউকে কিছু বলতে পারি না। তাই ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ছোট্ট একটা এসি কিনেই ফেললাম। যা আছে কপালে। বেতন থেকে প্রতি মাসে কিস্তি দিয়ে শোধ করে দেব। কী বলো?’
স্ত্রীর সঙ্গে মনে মনে কথা বলতে বলতে কখন ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন সামির সাহেব বুঝতেই পারেননি। হঠাৎ মনে হলো কীসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেলেন। ছিটকে পড়ে গেলেন রাস্তার ওপর। অনেক আওয়াজ আছড়ে পড়ছে কানে, হায়! হায়! মরে গেছে মনে হয়! আল্লারে! ওরে খোদা! কোনোমতে একবার চোখ খুলে সামির সাহেব দেখলেন রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার জামা প্যান্ট চোখ মুখ--সবকিছু। তার ঝাপসা দৃষ্টির ওপর দিয়ে মিলিয়ে গেল একটা দ্রুতগামী বাস।
বুঝে ওঠার আগেই চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো সামির সাহেবের।
Comments