"কিপটে বুড়ি, আমি আর কাজ করবো না তোমার বাড়িতে । হাড়-মাস জ্বালিয়ে খেল, নতুন বছরে দুশো টাকা মাত্র বোনাস চাইছি, তাও দেবে না ! ওই টাকা নিয়ে তুমি কি স্বর্গে যাবে ? তিন কুলে তো কেউ নেই ? কী করবে ওই টাকা দিয়ে তুমি ?"
"দরকার হলে, রাস্তার ভিখিরিদের দান করে দেব তবু এগারোশো টাকা মাইনের এক পয়সা বেশি পাবি না, এই বলে রাখলাম ।"
"এই শেষ, নাক-কান মুললাম, তোমার বাড়িতে যদি আর কাজে আসি তবে নাম বদলে দিও ।চললাম আমি ।"
এই নিয়ে প্রায় বার চল্লিশেক কাজ ছেড়েছে টুম্পা । প্রত্যেক বারই আর না আসার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে চলে গেছে, কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর, খুব বেশি হলে দুপুর ছেড়ে বিকেল, এই হল তার রাগের সীমারেখা । বহু চেষ্টা করে একবার সন্ধ্যে ছয়টা অবধি আসেনি সে, কিন্তু সাড়ে ছয়টায় মৃণালিনী দেবীর একটা ওষুধ আছে । তাই আবার সে ছুটতে ছুটতে গ্যাছে । ওই ওষুধ না খেলে বুড়ি সারা রাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারবে না ।
মৃণালিনী ভবনের এই মস্ত প্রাসাদের মতো বাড়িটার বিশাল গেটটা ঠেলে প্রতিদিনের মতো ভিতরে ঢোকে টুম্পা । তার শরীরে সকালের ঝগড়ার কোন রেশ নেই আর । ঘরে ঢুকেই একেবারে দিদিমনির কায়দায় শাসন শুরু করে দেয় সে -
"এই বুড়ি, দুপুরে খেয়েছো ?"
- "না খেয়ে কি তোর জন্যে বসে থাকবো মুখপুড়ি ? আসতে এত দেরি হলো যে ? সিরিয়ালের প্রথম পার্টটা তো হয়েই গেল ।"
- "সে হোক গে, ওষুধ খেয়েছো ?"
- "না ।"
- "দেখলে, একদিন একটু দেরিতে এসেছি অমনি অনিয়ম শুরু ।"
- "এই, মেলা জ্ঞান দিস না তো । বক্ বক্ না করে মুড়ি চানাচুরটা মেখে নিয়ে আয় দেখি । কুচি কুচি করে পিঁয়াজ দিস আর হ্যাঁ, একটা কাঁচা লঙ্কা চিরে আনবি ।"
- "খালি হুকুম আর হুকুম । এই নাও ওষুধ, গিলে আমায় শান্তি দাও ।"
- "হুম, আমি গেলে তুই তো শান্তিই পাস । বুড়ি মরলে তোকে দেখবে কে রে মুখপুড়ি ?"
- "ও নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না, আমাকে দেখার লোক অনেক আছে ।"
- "কেন রে প্রেম টেম করছিস নাকি ? বলিস নি তো !"
- "থামবে তুমি ?"
চলতে থাকে তাদের আবোলতাবোল বক বক । প্রতিদিন প্রায় এভাবেই সন্ধ্যে কাটে দু-জনের । দিন শুরু হয় ঝগড়া দিয়ে, শেষও হয় ঝগড়া দিয়ে । মাঝে লেগে থাকে এক রাশ অভিমান, আবদার, অভিযোগ আর খুনসুটি । দুজনের বয়সের পার্থক্য কম করে হলেও পঞ্চাশ-বাহান্ন হবে, অথচ বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে দুই বান্ধবী বসে ছেড়া পুতুলের মুন্ডু নিয়ে ঝগড়া করছে ।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ! দু-জনের ভাগ্য বোধহয় ঈশ্বর একই কলমে লিখে ছিলেন । টুম্পার স্বামী বিয়ের দেড় বছরের মাথায় তাকে ছেড়ে সৌদি আরব চলে যায় । আজ প্রায় সাত বছর হয়ে গেছে আর ফেরেনি সে । গত কয়েক বছর হলো টুম্পা অপেক্ষা করাও ছেড়ে দিয়েছে । উত্তর প্রদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে 'গুতেল মুন্সি' নামের এক দূর সম্পর্কের কাকু তাকে কলকাতায় নিয়ে আসে মাত্র দুই বছর বয়সে । তাই উত্তর প্রদেশের গ্রামের বাড়ি অথবা তার নিজের মা-বাবার মুখও মনে নেই তার । এবং না থাকাটাই স্বাভাবিক ।
গুতেল মুন্সি মদ খেয়ে খেয়ে নিজের শরীরটাকে শেষ করে ফেলেছিল, তাই কেউ আর তাকে কাজে নিতে চাইতো না । তাই খুব ছোট বয়স থেকেই এর ওর বাড়িতে কাজ করে, দু দুটো পেট চালাতে হতো টুম্পাকে । তারপর হঠাৎ একদিন রাত তিনটের দিকে খবর এলো তার ভিটেমাটির একমাত্র সাক্ষী, তার ওই গুতেল কাকু মদ্যপ অবস্থায় লরির নীচে পরে পার্থিব কষ্ট থেকে মুক্তিলাভ করেছে । খুব কেঁদেছিল সেদিন টুম্পা, যাও বা কিছু মাত্র শিকড় ছিল তাও সমূলে উপড়ে গেল । এবার সে সম্পূর্ণ উদ্বাস্তু হয়ে গেল । উত্তরপ্রদেশের কোথায় তার বাড়ি ? কে তার মা-বাবা ? কিছুই যে জানে না সে ।
অপর দিকে মৃণালিনী দেবীর স্বামী এলাকার বিখ্যাত উকিল উপেন স্যান্যাল, অগাধ সম্পত্তির মালিক । কিন্তু ভগবান সব দিক থেকে দু-হাত ভরে দিলেও মৃণালিনী দেবীর কোল ফাঁকা করে রেখেছিলেন । পার্কে বা স্কুলের সামনে সব মায়েদের তাদের নিজের বাচ্চাদের আদর করতে দেখলে তার বুকটা হু হু করে উঠতো, কিন্তু কিছুই করার ছিল না তার । জরায়ুতে টিউমার অপারেশনের সময় ডাক্তার বলেই দিয়েছিলেন সেই নির্মম সত্যটা । তারপর জীবনের একমাত্র সঙ্গী এই বৃদ্ধ বয়সে এসে, তার হাত ছেড়ে দিয়ে আকাশের বুকে জায়গা করে নিলো তা আজ প্রায় তিন বছর । যৌবন তাও বা কেটে যায় নেশায় নেশায়, বার্ধক্যের ব্যালকনিতে এলে প্রকৃত ভালোবাসার যে অর্থ উপলব্ধি করা যায়, তা তিনি প্রতিটা রাতেই ওপাশের ফাঁকা বালিশটাতে হাত বুলিয়ে অনুভব করতেন ।
এই ভাবেই জীবনের পথে হাঁটতে হাঁটতে দুই পথ হারানো নাবিক, দিকশূন্য সাগরের মাঝে একটা ছোট্ট দ্বীপ খুঁজে নিয়েছে নিজেদের জন্য ।
- "শোনো বুড়ি, বেশী রাত অবধি বই পড়ো না কিন্তু । ঘুম ঠিক করে না হলে কাল সারাদিন কিন্তু মাথা ব্যথা করবে, বুঝলে ?"
- "হুম বুঝেছি, অনেক রাত হয়ে গেল, যা এবার বাড়ি যা ।"
- "ধুর-র কোথায় রাত ? সবে সাড়ে নটা বাজে । যাই হোক শোনো, টেবিলের উপর ওষুধ রইলো রাতের, ঘুমাবার আগে খেয়ে নিও। আর গরম জল করে ফ্ল্যাক্সে রেখে গেলাম । ঠান্ডা জল খেয়ে আবার সর্দি বাঁধিয়ে বসো না কিন্তু ।"
- "আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, প্রতিদিন একই কথা মুখস্থের মতো আওড়িয়ে যাস । আমার কথা তো আর শুনবিও না ।"
- "তোমার আবার কি কথা ?
- "কত করে বলি, রাতটা এখানেই থেকে যা । না, রাতে তারকা রাক্ষসীর ঝুপড়িতে না গেলেই নয় । এই কে আছে রে তোর বাড়িতে ?"
- "দেখো বুড়ি ।"
- "এই থাম থাম ! আবার জ্ঞান দেবে । যা তুই যেদিকে মন চায়, কাল সময় মতো চলে আসিস ।"
প্রতিদিনই রাতে গেট দিয়ে বেরোনোর সময়, ভীষণ খারাপ লাগে টুম্পার । একা বয়স্ক মহিলা এত বড় বাড়িতে থাকে, রাত বিরেতে কিছু হয়ে গেলে কেউ জানতেও পারবে না ।
সত্যিই একদিন তেমনটাই হলো, রাতে উঠে বাথরুমে গিয়ে আর শোওয়ার ঘরে ফেরা হলো না মৃণালিনী দেবীর । পরদিন সকালে কাজে এসে টুম্পাই প্রথম জানতে পারে । যেদিন গুতেল কাকু মরে গেল সেদিনও এতটা কষ্ট হয়নি তার, যতটা আজ হচ্ছে । তার মনে হচ্ছিল ঈশ্বর যেন তার বুকের বাঁদিক থেকে একটা বড় অংশ কেটে নিয়ে গেলেন । মাকে পায়নি সে, কিন্তু ভগবান মা হারানোর কষ্টটা তার ভাগ্যের খাতায় সন্তর্পনে লিখতে ভুল করেননি । আজ যেন সম্পূর্ণ অনাথ হলো টুম্পা । সময়ের কাটা থেমে থাকেনি, চোখের জলের রেখাও বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছে আজ প্রায় পাঁচ মাস হতে চললো । বিশাল প্রাসাদের মতো সাদা ওই বাড়িটা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে । গেটে তালা ঝোলে, ওপাশে কেউ নেই, এপাশের মানুষটাও কেমন যেন পাথর হয়ে যায় দিন কে দিন ।
হঠাৎ একদিন বস্তির মোড়ে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো আর তার থেকে নেমে এলো কোট-টাই পড়া এক ভদ্রলোক । বস্তিতে কোনও বড় গাড়ি দেখলে এমনিতেই সকলে ভিড় করে দাঁড়ায়, এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি । লোকটি কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে করে সোজা টুম্পার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো । বাইরের চেঁচামেচি শুনে টুম্পাও ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে । লোকটি জিজ্ঞেস করলো -
"আপনি মিস টুম্পা সরকার ?"
- "হ্যাঁ ।"
- "আচ্ছা, আপনার ভোটার অথবা আধার কার্ডটা একবার একটু দেখতে পারি ?"
- "হ্যাঁ, কিন্তু.....মা...মা নে...আমি তো আপনাকে চিনি না আর টিভিতে যে বলে অচেনা কাউকে দরকারি কাগজ পত্র কিছু দিতে নেই ।"
- "না না, আপনার চিন্তার কোন কারণ নেই, আমি আমার পরিচয় বলছি । আমি স্বর্গীয় মিস্টার উপেন স্যান্যালের স্ত্রী স্বর্গীয়া মিসেস মৃণালিনী স্যান্যালের উকিল ছিলাম । আসলে মৃণালিনী দেবী নিজের স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে আপনাকে মনোনীত করে গেছেন । এখন আপনাকে এখানে একটা সই করতে হবে আর সেজন্যই একটা প্রমাণ থাকা তো জরুরি যে আপনিই আসল টুম্পা সরকার । ও হ্যাঁ, এর সাথে একটা চিঠিও রেখে গিয়েছেন ।"
কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা ধরলো টুম্পা । আগে হলে হয়তো এটা পড়ার সাধ্যি তার হতো না, কিন্ত মৃণালিনী দেবী তাকে পড়তে শিখিয়েছেন, পনের দিনে একটা গল্পের বই পড়তে হতো তাকে । তারপর তার থেকে মৃণালিনী দেবী প্রশ্ন করতেন । এইসব পুরোনো কথা মনে পড়লেই টুম্পার চোখের জল কোন বারণ না শুনেই অবাধে নেমে আসে । চিঠির ভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করলো সে.....
- "শোন মুখপুড়ি, তোর দায়িত্বে সব রেখে গেলাম । জানি তুই হেলায় নষ্ট করার মতো মেয়ে নোস, তবু মনে রাখিস আমি আর উনি কিন্তু উপর থেকে সব দেখছি । আমার বাড়িটা আজ থেকে তোকে দিলাম, আগের মতোই গুছিয়ে যত্ন করে রাখিস । আর শোন, আবার একটা বিয়ে করিস । একা একা সারা জীবন বেঁচে থাকা যায় না, ঝগড়া করারও একটা লোক চাই । আজ তো এই বুড়িটাও নেই যে গাল ফুলিয়ে সকাল সন্ধ্যে ঝগড়া করবি । ভাল থাকিস, নিজের একটু যত্ন নিস, চলি রে !"
ইতি,
তোর ঝগড়ুটে বুড়ি
থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে মাটির উপর বসে পড়ে টুম্পা । প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকার সম্পত্তি পেয়েও নিজেকে তার পৃথিবীর সব চাইতে নিঃস্ব ব্যক্তির থেকেও নিঃস্ব মনে হচ্ছিল ।
~~~~~
তিন তিনটে বছর কেটে গেছে তারপর, এখন মৃণালিনী ভবন শুধু একটি বাড়ি নয়, এটি একটি বৃদ্ধাশ্রম । এখানে টুম্পা মৃণালিনী দেবীর মতো এমন পঁয়ত্রিশ জনকে নিয়ে এসেছে যাদের সমাজ, পরিবার এমন কি ঈশ্বরও দূরে ঠেলে দিয়েছে । তাদেরই দু-হাতে বুকে টেনে নিয়েছে টুম্পা, জায়গা করে দিয়েছে মৃণালিনী ভবনে যাতে শেষ কটা দিন তারা যেন একাকিত্বে না বাঁচেন । টুম্পা যেন একা না থাকে, একটা ঝগড়া করার লোক খুঁজে নেয় এই তো ছিল মৃণালিনী দেবীর শেষ ইচ্ছে । সেটাই খুঁজে নিয়েছে সে, একটা দুটো নয় পঁয়ত্রিশটা ঝগড়ুটে বুড়ি । এখন সারাটা দিন মন খুলে সে তাদের সঙ্গে ঝগড়া করে ।
Comments