ভারতের সঙ্গে ১০টি চুক্তি বাতিল করা হয়েছে বলে যে তালিকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে, সেটা সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। মঙ্গলবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেছেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, যে তালিকাটা এসেছে, এটা কোনো একজন দিয়েছেন, সার্কুলেট (প্রচার) করেছেন। সেটা সম্ভবত কোনো একজন অ্যাডভাইজার রিটুইট করেছেন। তাঁর একটা কমেন্টসহ। কমেন্টটা নিয়ে আমি কোনো কমেন্ট করতে চাই না। হয়তো এটা উনি না করলেও পারতেন। যে তালিকাটা এসেছে, ওখানে এটা সঠিক নয়। এর অধিকাংশ (তালিকার চুক্তি) এক্সিস্ট করে না।
ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি অনেক আগেই বাতিল করা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘বাকিগুলোর কয়েকটি আছে যে বিভিন্ন পর্যায়ে আছে এবং ঠিক ওই নামে নেই। অন্য রকম ডেসক্রিপশনে (বিবরণ) আছে।’
গত সোমবার স্থানীয় সরকার ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে লেখা হয়, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরই চুক্তিগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং যথাযথ পর্যালোচনার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’
স্থানীয় সরকার ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এই তালিকা পোস্ট করা হয়েছিল
এর নিচে একটি তালিকা জুড়ে দেওয়া হয়। তার শিরোনামে লেখা হয়, ‘হাসিনা সরকারের আমলে ভারতের সাথে করা ১০ চুক্তি বাতিল, বাকিগুলোও বিবেচনাধীন।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম রেলসংযোগ প্রকল্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাতিল বলে উল্লেখ করা হলেও এ রকম কোনো প্রকল্প নেই। অভয়পুর-আখাউড়া রেলপথ সম্প্রসারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাতিল উল্লেখ করা হলেও এ রকম কোনো প্রকল্প নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আশুগঞ্জ-আগরতলা করিডোর বাতিল উল্লেখ করা হলেও হুবহু এ নামের কোনো প্রকল্প নেই। তবে ‘আশুগঞ্জ-সরাইল-ধারখার প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প চলমান আছে। ওই প্রকল্পের আওতায় কেবল একটি প্যাকেজ বাতিল হয়েছে (প্যাকেজ ৩: ধারখার থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর)। ফেনী নদীর পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাতিল উল্লেখ করা হলেও এ নামের কোনো প্রকল্প নেই। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ত্রিপুরার সাবরুম শহরে পানীয় জল সরবরাহের জন্য ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের জন্য ২০১৯ সালে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ওই সমঝোতা স্মারকটি বাতিল হয়নি।
উপদেষ্টা বলেন, কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন প্রকল্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে স্থগিত হিসেবে। এ নামের কোনো প্রকল্প নেই। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদী কুশিয়ারা থেকে পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০২২ সালে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। সমঝোতা স্মারকটি স্থগিত হয়নি। বন্দরের ব্যবহার সংক্রান্ত সড়ক ও নৌপথ উন্নয়ন চুক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাতিল উল্লেখ করা হলেও হুবহু এ নামের কোনো চুক্তি নেই। তবে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহনের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১৮ সালে চুক্তি সই হয়েছে। চুক্তিটি বাতিল হয়নি। চুক্তিটি বলবৎ আছে।
তৌহিদ হোসেন জানান, ফারাক্কা বাঁধসংক্রান্ত প্রকল্পে বাংলাদেশের আর্থিক সহযোগিতা প্রস্তাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাতিল হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এ রকম কোনো প্রস্তাবের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অবগত নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিলেট-শিলচর সংযোগ প্রকল্প বাতিল হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এ রকম কোনো প্রকল্প নেই। পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন সম্প্রসারণ চুক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাতিল উল্লেখ করা হলেও ভারতের সঙ্গে এ ধরনের কোনো চুক্তি হয়নি। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইনের আওতায় ভারতের নুমালীগড় থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত যে পাইপলাইন আছে, তা সম্প্রসারণের জন্য ভারতের সঙ্গে একবার প্রাথমিক আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি।
উপদেষ্টা জানান, ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্প (মিরসরাই ও মোংলা) বাতিল বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতীয় ঋণচুক্তির (এলওসি) আওতায় ওই প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নের বিষয়টি বাতিলের প্রক্রিয়া চলমান। আদানি পাওয়ার বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুনর্বিবেচনার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, চুক্তিটি পুনর্বিবেচনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলমান রয়েছে। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি (১৯৯৬) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নবায়ন/পুনর্বিবেচনা উল্লেখ করা হলেও ২০২৬ সালে চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হবে। চুক্তি নবায়নের জন্য আলোচনা হবে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি (খসড়া) (২০১১): বাস্তবায়নের জন্য আলোচনায় বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে। বাস্তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১০-২০১১ সালে খসড়া হওয়া তিস্তা চুক্তিটি এখনো স্বাক্ষরিত হয়নি। ভারতীয় প্রতিরক্ষা কোম্পানি জিআরএসইর সঙ্গে টাগ বোট চুক্তি বাতিল করা হয়েছে বলে তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত গার্ডেন রিচ শিপবিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের (জিআরএসই) থেকে ২১ মিলিয়ন ডলারে একটি সমুদ্রগামী টাগবোট কেনার চুক্তি করে বাংলাদেশ। প্রতিরক্ষা খাতে ভারতীয় ঋণচুক্তির ৫০০ মিলিয়ন ডলারের আওতায় এটি কেনার কথা ছিল। জিআরএসইর দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে এই চুক্তি বাতিলের তথ্য চলতি বছরের মে মাসে দিয়েছিল ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম।
ভারতীয় ঋণচুক্তির আওতায় কলকাতার গার্ডেন রিচ শিপবিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (জিআরএসই) থেকে টাগবোট কেনার চুক্তি বাতিলের যে তথ্য আসিফ মাহমুদের পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে, কেবল সেই তথ্যটি সঠিক বলে জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘জিআরএসই মানে গার্ডেন রিচের সাথে আমাদের একটা টাগবোট কেনার চুক্তি ছিল, সেটা আমরা বাতিল করেছি। বাতিল করা হয়েছে, বিবেচনা করে দেখা গেছে যে এটা বাংলাদেশের জন্য খুব লাভজনক না।’
উপদেষ্টা পরিষদের সহকর্মীর ‘সঠিক নয়’ এমন তথ্য শেয়ার করার মধ্য দিয়ে সরকারের সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পাচ্ছে কি না, সে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘এ নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।’
উপদেষ্টার মতো দায়িত্বশীল জায়গা থেকে ভবিষ্যতে এ ধরনের বক্তব্য না দেওয়ার বিষয়ে কোনো ‘অনুরোধ বা আহ্বান’ থাকবে কি না, এমন প্রশ্নে কোনো মন্তব্য না থাকার কথা বলেন তিনি।
বাংলাদেশে চলমান ভারতীয় প্রকল্পগুলোর বিষয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘প্রথমে প্রকল্পগুলো প্রায় সবই কিন্তু বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কারণ, সিকিউরিটি ইত্যাদি কারণে তারা…হয়তো আসলেও কিছু বাস্তব আর কিছু তারা বলছিল যে সিকিউরিটিতে খুব কমফোর্টেবল ফিল করছে না, এ কারণে বন্ধ হয়েছিল। তারপর আবার চালু হয়েছে।’
Comments