ঢাকাডিপ্লোম্যাটডটকম
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব না থাকলেও বিমসটেককে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক এম শহিদুল ইসলাম। তবে এখন শ্লথতা কাটিয়ে সংস্থাটির কর্মকাণ্ডে গতি আসছে বলে জানান তিনি। সোমবার কূটনীতি বিষয়ে বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন পত্রিকা ঢাকাডিপ্লোম্যাটডটকম’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি।
গত ৬ জুন ছিল বিমসটেক ডে। দিবসটি রোজার মাসে হওয়ায় ঢাকায় বিমসটেকের সদর দফতর আজ ২৫ জুন বিমসটেক ডে উদযাপন করতে যাচ্ছে। সন্ধ্যায় গুলশানে বিমসটেকের সদর দফতরে আয়োজন করা হয়েছে এক সম্মীলনী অনুষ্ঠানের।
বিমসটেক ডে’কে উপলক্ষ করে বিমসটেকের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ২৪ জুন সোমবার গুলশানে বিমসটেকের সদর দফতরে সংস্থার মহাপরিচালক এম শহিদুল ইসলামের মুখোমুখি হই।
শুরুতেই তিনি বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন-বিমসটেক গঠনের পটভূমি তুলে ধরেন।
১৯৯৭ সালের ৬ জুন ব্যাংককে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড-এই চারটি দেশ মিলে বিআইএসটি-ইসি গঠন করে। দেশগুলোর আদ্যাক্ষর দিয়ে আঞ্চলিক এই সংগঠনের নামকরণ করা হয়েছে । পরে মিয়ানমার যোগ দেওয়ায় এই সংস্থার নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা অ্যান্ড থাইল্যান্ড ইকোনমিক কো অপারেশন- বিমসটেক (বিআইএমএসটি-ইসি)। পরে ২০০৪ সালে নেপাল ও ভুটান যোগ দেওয়ার পর সংস্থাটির নতুন নামকরণ করা হয়। এটির নাম দেওয়া হয় বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন-বিমসটেক
বিমসটেকের মহাপরিচালক এম শহিদুল ইসলাম জানান, বিমসটেক গঠনের উদ্দেশ্য ছিল, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানো, বাণিজ্য বাড়ানো, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও জ্বালানি সহযোগিতা বাড়ানো।
তিনি বলেন, বিমসটেকের সাত সদস্যের পাঁচটি হলো দক্ষিণ এশিয়ার, দুটি হলো পূর্ব এশিয়ার। এর মানে হলো বিমসটেক দক্ষিণ এশিয়ার ও পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি সেতু বন্ধন হিসেবে কাজ করছে। দেশগুলো বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত। পাঁচটি দেশ একেবারে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে, আর অপর দুটি দেশ অর্থনৈতিক ভাবে, যোগাযোগ ও পরিবেশগত ভাবে সরাসরি বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভরশীল।
এম শহিদুল ইসলাম জানান, বিমসটেক যখন গঠিত হলো, তখন সার্ক ও আসিয়ান নামে দুটি শক্ত কাঠামোর আঞ্চলিক সংগঠন ছিল । তাহলে নতুন সংগঠনের কী প্রয়োজন ছিল। এই অঞ্চলের নেতৃত্বের ইচ্ছে ছিল, বাণিজ্যের মাধ্যমে বিমসটেকের সদস্যদেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানো, প্রযুক্তি হস্তান্তর, জ্বালানি সহযোগিতা বাড়ানো এবং যোগাযোগ বা কানেক্টিভিটি প্রতিষ্ঠা করা । যখন বিমসটেক গঠিত হলো, তখন মূলতঃ এটি ছিল প্রকল্পভিত্তিক সংস্থা। পরে এটি ভূমিকাভিত্তিক বা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক হয়ে পড়লো। ২০১৪ সালে ঢাকায় বিমসটেকের সদর দফতর হলো। তারপর ১৪টি খাত বা সেক্টর চিহ্নিত হলো। যেমনঃ বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সন্ত্রাস দমন, জলবায়ু পরিবর্তন, কানেক্টিভিটি। ২০০৪ সালে বিমসটেক ফ্রি ট্রেড ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট সই হলো। বিমসটেক ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট সইয়ের জন্য দরকষাকষি চলছে। এই চুক্তিতে কয়েকটি উপাদান বা কম্পোনেন্ট রয়েছে। যেমনঃ একটি ট্রেড অ্যান্ড গুডস এগ্রিমেন্ট, একটি ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট এগ্রিমেন্ট, অপরটি ট্রেড অ্যান্ড সার্ভিসেস এগ্রিমেন্ট।
বিমসটেকের মহাপরিচালক এম শহিদুল ইসলাম তাঁর প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতার দিকগুলোও অকপটে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সার্ক এবং আসিয়ানের কর্মসূচি বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় অনেক গ্যাপ দিয়ে বিমসটেকের মিটিংগুলো হয়ে আসছিল। তিনি আরও বলেন, আসলে বিমসটেকের সদস্যদেশগুলোর অগ্রাধিকার বিষয়ে আমরা নিশ্চিত না। অন্যান্য বিষয়ে সদস্যদেশগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় এনগেজমেন্ট আমরা দেখি। কাজেই এটা যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ছিল সেটা না, তারপর অগ্রাধিকার নীচের দিকে ছিল, ওপরের দিকে না।
বিমসটেকের এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে জানিয়ে বিমসটেকের মহাপরিচালক এম শহিদুল ইসলাম বলেন, ২০১৮ সালে নেপালে বিমসটেকের শীর্ষ সম্মেলনে চার্টার তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। একটা খসড়া তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন মিটিংয়ের নিয়মকানুন তৈরি করা হয়েছে। পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলনে চার্টার চূড়ান্ত হবে। সম্মেলনটি হবে শ্রীলঙ্কায় ২০২০ সালে।
প্রতিষ্ঠার পর আজ পর্যন্ত বিমসটেকের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে এটির কোনো কাঠামো ছিল না। এখন সংস্থাটির একটি সদর দফতর হয়েছে। আগে তিনজন পরিচালক ছিল, এখন সাতজন হচ্ছে। এই মুহূর্তে পাঁচজন পরিচালক আছে। তারপর চার্টার হতে যাচ্ছে। তহবিল তৈরির মেকানিজম নিয়ে সমস্যা ছিল। এখন বিমসটেক উন্নয়ন তহবিল তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। কেউ বলছে শুরুতে তহবিল ২ বিলিয়ন ডলার হোক, কেউ বলছে শুরুতে ৫০ মিলিয়ন ডলার হোক। বিমসটেক আবহাওয়া ও জলবায়ু ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করতা হয়েছে ভারতে। এছাড়া বিমসটেক এনার্জি সেন্টার ও কালচারাল সেন্টার হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় প্রযুক্তি হস্তান্তর বিষয়ে সেন্টার হতে যাচ্ছে।
মহাপরিচালক এম শহিদুল ইসলাম বলেন, বিমসটেকের কেন্দ্রগুলোকে কার্যকর দেখতে চাইলে যত কম সেন্টার করা যায়, ততই ভালো। সে বিষয়ে আমার আবেদন ছিল। সহযোগিতার ১৪টি ক্ষেত্রকেও কমিয়ে আনার পক্ষে তিনি মত দিয়েছেন। ইউনেস্কোর পাঁচটি খাতের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট এবং কর্মচারীর সংখ্যা পনেরশর বেশি। আর বিমসটেকে রয়েছে মাত্র ২০ জনের লোকবল, আর বাজেট ১ মিলিয়নের চেয়ে বেশি।
কবে নাগাদ বিমসটেক ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট সই হতে পারে জানতে চাইলে মহাপরিচালক এম শহিদুল ইসলাম জানান, আমরা আশা করছি ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টের প্রধান উপাদান-ট্রেড অ্যান্ড গুডস এগ্রিমেন্ট এবছরের মধ্যে করা সম্ভব হবে। তিনি আরও জানান, এনার্জি সহযোগিতার ওপর একটি এমওইউ সই হয়েছে। সেটা হচ্ছে গ্রীড ইন্টার কানেকশান। প্রত্যেকটা দেশের রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন যেন অভিন্ন করা যায়, সেটি নিয়ে আলোচনা চলছে। যাতে ইলেক্ট্রিসিটি আর ট্রেড ফেসিলিটেড করা যায়। চুক্তিটি কার্যকর করার জন্য এখন আমরা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এডিবির সঙ্গে কথা বলছি। তারা রাজি হয়েছে সহযোগিতা দিতে। মাস্টার প্ল্যান অন ইন্টার গ্রীড কানেকশান তৈরির জন্য এডিবি একটি স্টাডি করবে। ট্রান্সপোর্ট কানেক্টিভিটির জন্য দুটি চুক্তি হচ্ছে। একটি মোটর ভিহিক্যাল চুক্তি, আরেকটা কোস্টাল শিপিং চুক্তি। বিমসটেক ট্রান্সপোর্ট কানেক্টিভিটির মাস্টার প্ল্যান তৈরির জন্য এডিবির করা স্টাডি প্রায় শেষ। এবছরই ড্রাগ প্রতিবেদন মিয়ানমার থেকে প্রকাশ হবে।
বিমসটেক নিয়ে আগে যে অনিশ্চয়তা ছিল, এখন তা নেই বলে মনে করেন মহাপরিচালক এম শহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সন্ত্রাস দমনের ওপর বিমসটেক জোর দিয়েছে। ২০০৯ সালে একটি কনভেশন সই হয়েছে। যদিও এটি রেটিফাই হয়নি। ভুটান করেনি। বিমস্টেক কনভেনশন অন মিউচুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্স ইন ক্রিমিনাল ম্যাটারস সই হবে শিগগিরই।
একটু হতাশা প্রকাশ করে বিমসটেক মহাপরিচালক এম শহিদুল ইসলাম বলেন, সংস্থাটির বিভিন্ন পররায়ে হওয়া বৈঠকে বা মিটিংয়ে অনেক ভালো ভালো ধারণা আসে, কিন্তু প্রতিনিধিরা নিজ নিজ দেশে যাওয়ার পর সব ভুলে যান।
সদস্যদেশগুলোরে চাঁদা দিয়েই সংস্থাটি চলছে জানিয়েছেন মহাপরিচালক এম শহিদুল ইসলাম । মোট চাঁদার ভারত ৩০ শতাংশ, থাইল্যান্ড ১৭ শতাংশ ও বাংলাদেশ ১৪ শতাংশ দিয়ে থাকে।
বিমসটেকের নতুন সদস্যপদ দেওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা বা এক্সেস না থাকলে সদস্যপদ দেওয়া হবেনা। এক্ষেত্রে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের সম্ভাবনা আছে। আসলে এই মুহূর্তে সদস্যদেশগুলোর নতুন করে সদস্য নেওয়ার ইচ্ছে নেই। পর্যবেক্ষক নেওয়ার সুযোগ থাকলেও এই মুহূর্তে কোনো আবেদন নেই।
এবছর বাংলাদেশে দুটি মন্ত্রী পর্যায়ের মিটিং হবে বলে জানান মহাপরিচালক এম শহিদুল ইসলাম । কালচারাল মন্ত্রীদের বৈঠক জুলাইয়ে ও পর্যটনমন্ত্রীদের বৈঠক হবে সেপ্টেম্বরে।
বিমসটেক ডে উপলক্ষে নেতাদের বাণীঃ বিমসটেক ডে উপলক্ষে সদস্যদেশগুলোর শীর্ষ নেতারা বাণী দিয়েছেন। পৃথক বাণীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিমসটেক নেতারা সংস্থাটিকে আরও গতিশীল, ফলদায়ক ও পারস্পারিক উপকারে আসার মতো করে গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন।
Comments