শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

বিশ্ব শরণার্থী দিবস ও জলবায়ু শরণার্থী

মোঃ জাহাঙ্গীর আলম
|  ১৯ জুন ২০২৩, ২২:২৪

আধুনিক এই বিশ্বে একটি বিশাল সংখ্যাক জনগোষ্ঠী এখনও নির্যাতন, সংঘাত, যুদ্ধ বা সহিংসতার কারণে নিজ ঘরবাড়ি ও দেশ থেকে পালিয়ে শরণার্থী জীবনযাপন করছে। ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা, রাজনৈতিক মতাদর্শ অথবা বিশেষ কোনো সামাজিক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হওয়ার কারণেই সংঘাত, যুদ্ধ আর সহিংসতা এবং ফলাফল বিরাট সংখ্যাক জনগোষ্ঠীর শরণার্থীর জীবনযাপন। সম্প্রতি বছরগুলোতে নতুন করে যোগ হচ্ছে জলবায়ু শরণার্থী। বিশ্বে বেড়ে চলছে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা, যদিও জলবায়ু শরণার্থীর ইস্যুটি এখনো অত বড়ো করে দেখা হচ্ছে না। শরণার্থী ইস্যুটি বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ও চলমান সমস্যার একটি। নানান কারণেই দিন দিন শরণার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ইউএনএইচসিআর বলেছে, গত একবছর বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছে এক কোটি ৯০ লাখ মানুষ। এর আগে কখনো এক বছরে বাস্তুচ্যুত এত বাড়েনি। গত দুই মাসে সুদান এবং একবছরের বেশি সময় ধরে ইউক্রেনের সংঘাতের কারণে বর্তমানে বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১১ কোটি হয়েছে।

ইউএনএইচসিআরের বৈশ্বিক বাস্তুচ্যুতি বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে অনুসারে রুশ আক্রমণের পর প্রায় ১ কোটি ১৪ লাখ ইউক্রেনীয় নাগরিক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। তাদের অনেকেই এখন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে। বর্তমান বিশ্বে গড়ে প্রতি ৭৪ জনের মধ্যে একজনের বেশি মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির শিকার। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির মধ্যে একটি বড়ো অংশ শরণার্থী। এসব শরণার্থীরা অস্থায়ী ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। তাদের নির্দিষ্ট দেশ নেই, নিরাপত্তাহীনতা, অবহেলা আর বঞ্চনায় কাটে জীবন। শরণার্থীদের মৌলিক, মানবিক ও নিরাপত্তা অধিকার নেই বললেই চলে। বিশ্বের অনেক স্থানেই আজ শরণার্থীদের মৌলিক ও মানবিক অধিকার, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা হুমকির মুখে। তাই আন্তর্জাতিক মহলে শরণার্থীদের অধিকার বাস্তবায়নে বহুবিধ আলোচনা হচ্ছে। তবে তাদের অধিকারের পাওয়ার বিষয়টি এখনো পরিপূর্ণতা পায়নি।

সাধারণত নির্যাতন, সংঘাত, যুদ্ধ বা সহিংসতার হাত থেকে বাঁচতে নিজ ঘরবাড়ি ও দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হওয়া মানুষকে শরণার্থী বা উদ্বাস্তু বলে। জাতিসংঘের মতে, কোনো ব্যক্তির বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা, নির্দিষ্ট কোনো সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্যপদ থাকা অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকার কারণে যদি তার ওপর নির্যাতনেরসমূহ সম্ভাবনা থাকে, তবে নিজ ঘরবাড়ি ও দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সেসব জনগোষ্ঠী শরণার্থী হিসেবে গণ্য হয়। এর সাথে নতুন করে যোগ হওয়া  জলবায়ু শরণার্থী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যারা বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, তারাই জলবায়ু শরণার্থী। 

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের  শেষ নাগাদ পর্যন্ত নিপীড়ন, সংঘাত, সহিংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে বাঁচতে সারা বিশ্বের জোরপূর্বক বাস্তচ্যুতদের সংখ্যা ১০৮.৪ মিলিয়ন অতিক্রম করেছে। এই নতুন রেকর্ড  সুদান  এবং ইউক্রেন যুদ্ধসহ অন্যান্য সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা এত বেড়েছে বলে মনে করছে ইউএনএইচসিআর। বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ২০২২ সালের শেষ নাগাদ ১০ কোটির মতো ছিল। ইউক্রেন, ইথিওপিয়া, বুরকিনা ফাসো, মিয়ানমার, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান এবং কঙ্গোতে সংঘাতের কারণে মূলত সংখ্যাটি বাড়ছিল৷ তবে চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে সুদানের যুদ্ধ শুরু হলে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে৷ ১০ কোটির বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার অর্থ হচ্ছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশের অধিক মানুষ আর নিজের ঘরে থাকতে পারছে না৷ এই সংখ্যার মধ্যে শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী এবং নিজের দেশেই ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়া ছয় কোটির মতো মানুষও রয়েছে৷

ইউএনএইচসিআর এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষে সারাবিশ্বে ১০৮.৪ মিলিয়ন মানুষ বলপূর্বক নিজ ভিটামাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫.৩ মিলিয়ন উদ্বাস্তু বা শরণার্থী, ৬২.৫ মিলিয়ন অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ, ৫.৪ মিলিয়ন আশ্রয়প্রার্থী এবং ৫.২ মিলিয়ন বিদেশে বাস্তুচ্যুত, যাদের আন্তর্জাতিক সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি শরণার্থী এসেছে দক্ষিণ সুদান, আফগানিস্তান এবং সিরিয়া থেকে। দেশগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহসহ নানা সমস্যার কারণে এসব মানুষ বর্তমানে শরণার্থী। এ শরণার্থীদের আশ্রয়দান করেছে তুরস্ক, পাকিস্তান, লেবানন, ইরান, উগান্ডা এবং ইথিওপিয়া। বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের এক-তৃতীয়াংশকেই আশ্রয় দিয়েছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো।

বাংলাদেশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়দানকারী একটি দেশ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার তার নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করায় বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে তারা স্টেটলেস (রাষ্ট্রহীন)। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ‘রাষ্ট্রহীন’ এখন বাংলাদেশে। ইউএনএইচসিআরের হিসাবে ২০২২ সাল শেষে বাংলাদেশে রাষ্ট্রহীন মানুষের সংখ্যা ৯ লাখ ৫২ হাজার ৩শত। সম্পূর্ণ মানবিক কারণে মিয়ানমারের এই বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়েছে এবং মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ২০১৬ সালে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বড়ো অংশকে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য করে মিয়ানমার। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে প্রথম আশ্রয় নিয়েছিল ১৯৭৮ সালে।

শরণার্থীদের অধিকার সুরক্ষায় বড়ো মাধ্যম হলো ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন এবং ১৯৬৭ সালের প্রটোকলের সঠিক ব্যবহার। এছাড়া ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র (The Universal Declaration of Human Right) এর বাস্তবায়ন। বর্তমানে বিশ্বের ৩৫.৩ মিলিয়ন উদ্বাস্তু বা শরণার্থীদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত জরুরি। ইউএনএইচসিআর শরণার্থী অধিকার বাস্তবায়নের নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শরণার্থীদের নিরাপত্তা অধিকার ফিরে পাওয়ার মাধ্যম হচ্ছে নিরাপদ আবাসস্থল, জাতি পরিচয় এবং পাশাপাশি মৌলিক ও মানবাধিকার অধিকার ফিরে পাওয়া। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্ব শরণার্থী দিবসটি পালিত হয় এক একটি প্রতিপাদ্য ধরে। বিশ্ব শরণার্থী দিবস ২০২৩ এর মূল প্রতিপাদ্য: “Hope away from Home. A world where refugees are always included”. ঘর হতে সুদূরে আশা, এমন একটি বিশ্বের যেখানে শরণার্থীরা নিয়তই অন্তুর্ভুক্ত।

মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিরূপ পরিস্থিতির কারণে কোনো স্থানের মানুষ যখন নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বসবাস করতে বাধ্য হয়, তখন তাদের বলা হয় জলবায়ু শরণার্থী। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীরা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের বহু অঞ্চল বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। এসকল অঞ্চলের অনেক পরিবার ঘর ও বসবাসের জায়গা হারাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের ধারণা অনুযায়ী, আগামী ২৫ বছরের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে ২০ কোটিরও বেশি মানুষ নিজ বাড়ি ছেড়ে দেশের মধ্যেই অন্য স্থানে যেতে বাধ্য হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশে বেড়ে চলছে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা। বাংলাদেশের জলবায়ু শরণার্থীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দারা। বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু শরণার্থীদের জন্য অশ্রয়ণ প্রকল্প তৈরি করছে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে জলবায়ু শরণার্থীদের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম পুনর্বাসন প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। বৃহৎ এ প্রকল্পে নির্মিত ২০টি পাঁচতলাবিশিষ্ট ভবনে ৬০০টি  জলবায়ু শরণার্থী পরিবার নতুন ফ্ল্যাট পেল। প্রতিটি পাঁচতলা ভবনে থাকছে ৪৫৬ বর্গফুট আয়তনের ৩২টি করে ফ্ল্যাট। পর্যায়ক্রমে ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবার এখানে ফ্ল্যাট পাবে।

ইউএনএইচসিআরের প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেন জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির নতুন রেকর্ডের জন্য সংঘাত, নিপীড়ন, বৈষম্য, সহিংসতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো কারণগুলো দায়ী। শরণার্থী ও অভিবাসী বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, বর্তমান সময়ে জলবায়ু শরণার্থী বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। কেননা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাব বেড়েই চলছে, তার সাথে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যাও। আমরা আশা করি, সংঘাত, নিপীড়ন, বৈষম্য, সহিংসতা মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত শরণার্থী বা জলবায়ু শরণার্থী যেন একটি স্থায়ী বিষয় না হয়। বিশ্বের শরণার্থীদের মৌলিক ও মানবাধিকার ফিরিয়ে দিতে রাষ্ট্রসমূহ আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে এইটাই এ বিশ্ব শরণার্থী দিবসের প্রত্যাশা আমাদের। আমরা প্রতিজ্ঞা করবো বিশ্বের সকল শরণার্থীদের নিরাপত্তা অধিকার পায়। আমরা আরও মানবিক হবো, আর ভাববো তারাও আমাদের পরিবারের কেউ। প্রতিটি শরণার্থী তাদের ঘরে ফিরে যাক।  ১১ কোটি অধিক বাস্তুচ্যুত মানুষের মৌলিক-মানবিক ও নিরাপত্তা অধিকার রক্ষা এবং সুস্বাস্থ্য স্বাভাবিক জীবনযাপনের প্রত্যাশা করি বিশ্ব শরণার্থী দিবসের এই দিনে।

লেখক: সিনিয়র সহকারী সচিব, জনকূটনীতি অনুবিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা

পিআইডি ফিচার

 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত