সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Monday, 16 September, 2024
বিবিসির প্রতিবেদন

শেখ হাসিনা ইস্যুতে ভারতের অবস্থান কী হবে

ঢাকা ডিপ্লোমেট আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
  03 Sep 2024, 17:39
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা....................................ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে বিশৃঙ্খলভাবে পালিয়ে তড়িঘড়ি করে দিল্লির কাছে একটি সামরিক ঘাঁটিতে অবতরণ করার প্রায় এক মাস হয়ে গেছে। টানা ছাত্র আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে গত ৫ আগস্ট নাটকীয়ভাবে হাসিনা সরকারের পতন হয়। তিনি ওই দিনই সামরিক বিমানে করে ভারতে পালিয়ে যান।

প্রাথমিকভাবে তিনি অল্প সময়ের জন্য ভারতে থাকবেন বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে আশ্রয় নেওয়ার তার প্রচেষ্টা এখনও পর্যন্ত সফল হয়নি। ভারতে হাসিনার অব্যাহত উপস্থিতি ঢাকার নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দিল্লির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

ভারতের কাছে বাংলাদেশ শুধু প্রতিবেশী একটি দেশ নয়। এটি একটি কৌশলগত অংশীদার এবং ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘনিষ্ঠ মিত্র, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর জন্য।

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, যা ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো থেকে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করা তুলনামূলকভাবে সহজে করে তোলে।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভারত এই জাতিগত স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলোকে দমন করে। শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে বেশ কয়েকটি সীমান্ত বিরোধও বন্ধুত্বপূর্ণভাবে মীমাংসা করেন।

দুই দেশের সম্পর্কের মূল বিষয় সীমান্ত নিরাপত্তা থাকলেও এর আর্থিক দিকও রয়েছে। হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক ও সংযোগ বিকাশিত হয়েছে। ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সড়ক, নদী ও রেলপথ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে।

২০১০ সাল থেকে ভারত অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশকে সাত বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছে।

হাসিনার আকস্মিক পতনের মানে হলো দিল্লিকে এখন কঠোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে যাতে বাংলাদেশে তাদের লাভগুলো ভেস্তে না যায়। 

ঢাকার সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘এটি এই অর্থে একটি ধাক্কা যে আমাদের আশপাশে যেকোনো অশান্তি সবসময়ই অবাঞ্ছিত।’

তবে সাবেক এই কূটনীতিক জোর দিয়ে বলেছেন, ‘ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করবে দিল্লি। কারণ আর কোনো বিকল্প উপায় নেই। ঢাকা অভ্যন্তরীণভাবে যা করবে তা আপনি নির্দেশ করতে পারবেন না।’

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পৌঁছাতে ভারত সরকার সময় নষ্ট করেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপচারিতা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। 

তবে, গত ১৫ বছর ধরে হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের অটল সমর্থনের কারণে অনেকের মনে যে ক্ষোভ রয়েছে, তা প্রশমিত করতে দিল্লির কিছুটা সময় লাগবে।

অনেক বাংলাদেশি ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভের জন্য দায়ী করেন- তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে হাসিনার দলের জয়কে দিল্লির দ্রুত সমর্থন করাকে। 

হাসিনার পতনের পর দিল্লির ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিটি আরেকটি ধাক্কা খেয়েছে। কারণ ভারতের আধিপত্য ঠেকাতে মালদ্বীপ ও নেপালের মতো বাংলাদেশও ইঙ্গিত দিচ্ছে।  

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত যদি একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে নিজের মর্যাদা রক্ষা করতে চায় তাহলে অন্য  কোনো প্রতিবেশী দেশে তার প্রভাব হারাতে চাইবে না। কেননা ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনও এই অঞ্চলে দীর্ঘ দিন ধরে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে আসছে।

গত বছর মালদ্বীপে প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়ী হন মোহম্মদ মুইজ্জু।

ঢাকার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘ভারতের জন্য তার আঞ্চলিক নীতি সম্পর্কে আত্মপর্যালোচনার সময় এসেছে। দিল্লিকে দেখাতে হবে যে, তারা তার আঞ্চলিক অংশীদারদের দৃষ্টিভঙ্গি যথাযথভাবে গ্রহণ করেছে কিনা। আমি শুধু বাংলাদেশের কথাই বলছি না, এর পাশাপাশি এই অঞ্চলের প্রায় সব দেশের কথাই বলছি।’

উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের সরকারগুলো বাংলাদেশের অন্যান্য বিরোধী দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।

বিএনপির সিনিয়র নেতা আব্দুল মঈন খান বলেন, ভারত একরকম ভেবেছিল যে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার বাংলাদেশের ভেতরে একমাত্র মিত্র। এটা একটা কৌশলগত ভুল।

সামনের দিনে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিজয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী বিএনপি নেতারা। আর এমনটা হলে দিল্লির জন্য কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এর আগে দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ও ভারতের মধ্যে আস্থার ঘাটতি রয়েছে।

আগামী দিনে নিজেদের মতভেদ কাটিয়ে কাজ করার পথ খুঁজতে হবে দিল্লি ও বিএনপি নেতাদের।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। দিল্লির অভিযোগ ছিল, ভারতের উত্তর-পূর্বের বিদ্রোহীদের আশ্রয় দিচ্ছে ঢাকা।

এ ছাড়া ২০০১ সালে বাংলাদেশের হিন্দু নেতারা অভিযোগ করেন, বিএনপি এবং ইসলামপন্থি দলগুলো নির্বাচনে জয় লাভের পরপরই সংখ্যালঘুদের হত্যা, লুটপাট ও ধর্ষণসহ নানা ধরনের আক্রমণ করেছে। 

বিএনপি ভারত বিরোধী বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এবং ২০০১ সালে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

মঈন খানসহ বিএনপি নেতারা বলছেন, ভারত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এগিয়ে আসেনি। এখন দিল্লির নীতি পরিবর্তনের সময় এসেছে। তিনি এ-ও বলেন, ভারতের সঙ্গে নৈকট্য, এর আকার এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবিরোধী বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেয়ার মতো ভুল তার দল করবে না।

বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ভারতবিরোধী মনোভবের আরেকটি কারণ রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। আর পানি বণ্টন ইস্যু দুই দেশের মধ্যে বেশ বিতর্কিত একটি বিষয়।

কীভাবে ভুল তথ্য দুই দেশের মধ্যে সন্দেহের জন্ম দিতে পারে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট সাম্প্রতিক বন্যা তার একটি উদাহরণ। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আকস্মিক প্রবল বর্ষণের জেরে গোমতি নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে ত্রিপুরা ও প্রতিবেশী বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়।

বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে তাদের ঘরবাড়ি, জিনিসপত্র ও কৃষিজমি হারিয়েছে। অনেক গ্রামবাসী ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা ভারতকে অভিযুক্ত করে বলেছেন, রাতের আঁধারে ইচ্ছাকৃতভাবে বাঁধের গেট খুলে দিয়েছে ভারত। যার ফলে এই বন্যা হয়েছে।

এ ঘটনায় অভিযোগটি অস্বীকার করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি জারি করতে বাধ্য হয়। যেখানে বলা হয়, গোমতি নদীর অববাহিকা এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে এই বন্যা হয়েছে।

বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের মাথাব্যথার আরেকটি কারণ হলো চীন। ভারতের সাথে আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াইয়ে বেইজিং বাংলাদেশ তাদের নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে আগ্রহী।

মালদ্বীপে নির্বাচনে জয়লাভের পর প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরের জন্য চীনকে বেছে নেওয়ায় তাকে লাল গালিচা বিছিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল বেইজিং।

বাংলাদেশ নিয়েও একই পরিণতি এড়াতে চাইবে দিল্লি। ভারতীয় পণ্য ও বাণিজ্যের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে কূটনৈতিক কৌশল প্রণয়ন ও ইমেজ পরিবর্তনে কিছুটা সময় পাওয়ার প্রত্যাশা করবে দিল্লি।

তাই ভারতে হাসিনার উপস্থিতি ঘিরে সাবধানে পা ফেলতে হবে দিল্লিকে, বিশেষ করে যদি নতুন সরকার ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের অনুরোধ করে। 

গত মাসে হাসিনার পক্ষে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি বিবৃতি ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

কিন্তু এটাও সত্য যে, হাসিনার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত থাকলে তাকে ভারত ছাড়তে বলবে না দিল্লি।

ঢাকার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সতর্ক করে বলেছেন, ‘ভারতে তাকে কীভাবে আতিথেয়তা দেয়া হয়, তা বিবেচ্য নয়। কিন্তু সেখানে থেকে তিনি কীভাবে ঘরোয়া বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন তা বাংলাদেশিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যদি তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাহলে তা শত্রুতামূলক কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে।’

দিল্লির কূটনীতিকদের প্রত্যাশা, শেখ হাসিনা ভারতের মুখাপেক্ষী হয়ে না থেকে নিজের একটা ব্যবস্থা করবেন।

Comments

  • Latest
  • Popular

অবিলম্বে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে: ফখরুল

ঢাকার যানজট নিরসনের উপায় খুঁজতে নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্তকে ডিএমপির কাছে হস্তান্তর

ডেঙ্গুতে মৃত্যু ১, হাসপাতালে আরও ২৬৭

হাসিনার সঙ্গে আসামি হলেন অরুনা-প্রাচী

মমতার ডাকে বৈঠকে রাজি আন্দোলনকারীরা

আসাদুজ্জামান নূর ও মাহবুব আলী কারাগারে

প্রকাশ্যে এলো শেখ হাসিনার পদত্যাগ পত্র

ছুটির দিনেও আশুলিয়ায় ১৪০০ কারখানায় চলছে কাজ

রাজধানীতে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও সমাবেশ

১০
মমতার ডাকে বৈঠকে রাজি আন্দোলনকারীরা
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘শেষ চেষ্টা’র জেরে নিজেদের শর্ত থেকে সরে এসেই কি অবশেষে বৈঠকে রাজি
চীনে ৭০ বছর পর শক্তিশালী টাইফুনের আঘাত
চীনের বাণিজ্যিক অঞ্চল সাংহাইতে টাইফুন ‘বেবিনকা’ আঘাত হেনেছে। দীর্ঘ ৭০ বছর পর কোনো শক্তিশালী টাইফুন
মিয়ানমারে বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭৪
মিয়ানমারে সুপার টাইফুন ইয়াগির প্রভাবে ভারী বর্ষণের ফলে সৃষ্ট বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে কমপক্ষে ৭৪
কুয়েতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ জাবের আর নেই
কুয়েতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ জাবের মুবারক আল হামাদ আল মুবারক আল সাবাহ আর নেই (ইন্নালিল্লাহে....রাজেউন)।  শনিবার
Error!: SQLSTATE[42S22]: Column not found: 1054 Unknown column 'parent_cat_type' in 'field list'