তাঁর কণ্ঠের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ। তাঁর দৃপ্ত গায়কির আকর্ষণ আচ্ছন্ন করেছে বাংলা গানের শ্রোতাদের। বাংলাদেশের লালনসংগীতের সঙ্গে যাঁর নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে, সেই ফরিদা পারভীন আর নেই। শনিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে ঢাকায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। খবরটি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার চক্রবর্তী ও ফরিদা পারভীনের ছেলে ইমাম নিমেরি উপল।
মৃত্যুকালে ফরিদা পারভীনের বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন ফরিদা পারভীন। কিছুদিন ধরে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল, সপ্তাহে দুই দিন তাঁকে ডায়ালাইসিস করাতে হতো। এর আগেও সংকটাপন্ন অবস্থায় বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল ফরিদাকে। কিন্তু পরিবারের সদস্য-অনুরাগীদের আশ্বস্ত করে প্রতিবারই সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। নিয়মিত ডায়ালাইসিসের অংশ হিসেবে ২ সেপ্টেম্বর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু ডায়ালাইসিসের পর তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তখন চিকিৎসক তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন। এর পর থেকে তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত বুধবার অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শনিবার দুপুরে প্রথম আলোকে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার চক্রবর্তী বলেছিলেন, ফরিদা পারভীনের কিডনি, ব্রেন কাজ করছে না। ফুসফুসে সমস্যা আছে। হার্টে অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন আছে। রক্তের সংক্রমণ সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে। রক্তচাপ কম থাকার কারণে ডায়ালাইসিস দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আশীষ কুমার চক্রবর্তী রাতে মন খারাপ করা খবরটি জানিয়ে বলেন, ‘আমরা আর পারলাম না আপাকে ফেরাতে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক করেছেন তিনি।’
শৈশবের রোদ্দুর থেকে গানের হাতেখড়ি
ফরিদা পারভীনকে বলা হতো ‘লালনসম্রাজ্ঞী’। লালন সাঁইজির গানের প্রসঙ্গ উঠলে প্রথমেই বাঙালির কানে ভেসে উঠত তাঁর কণ্ঠস্বর। দীর্ঘ সংগীতজীবনে তিনি লালনের গানকে বিশ্বপরিসরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানার শাঁঔঁল গ্রামে জন্ম নেন ফরিদা পারভীন। শৈশবের দিনগুলো কেটেছে মাগুরা, নাটোর, কুষ্টিয়া—দেশের নানা প্রান্তে। বাবার চাকরির বদলির কারণে ঘুরে বেড়ানো সেই শৈশবেই শুরু হয় গানের হাতেখড়ি। মাত্র চার-পাঁচ বছর বয়সে ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে প্রথম গান শেখা। তারপর নজরুলসংগীত দিয়ে তাঁর শিল্পীজীবনের সূচনা। ১৯৬৮ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি রাজশাহী বেতারে তালিকাভুক্ত নজরুলসংগীতশিল্পী হন। কিন্তু ভাগ্য যেন তাঁকে অন্য পথে নিয়ে যেতে চাইছিল, সেই পথের নাম—লালন।
লালনের গানে মোড় ঘোরা জীবন
স্বাধীনতার পর কুষ্টিয়ার দোলপূর্ণিমার মহাসমাবেশে প্রথমবারের মতো লালনের গান পরিবেশন করেন ফরিদা পারভীন। সেই গান ছিল—‘সত্য বল সুপথে চল’। শ্রোতার আবেগ, উচ্ছ্বাস আর প্রশংসা তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, এই পথেই তাঁর যাত্রা। শুরুতে অনীহা থাকলেও বাবার উৎসাহে মকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে লালনের গান শেখা শুরু করেন। এরপর খোদা বক্স সাঁই, করিম সাঁই, ব্রজেন দাসসহ গুরুপরম্পরার সাধকদের কাছে তালিম নিয়ে লালনের গানকে তিনি কণ্ঠে ধারণ করেন। তাঁর কণ্ঠে লালনের গান হয়ে ওঠে শুধু সংগীত নয়, এক অনন্য জীবনদর্শন। জীবনকালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা ঘটে।
কুষ্টিয়ায় স্থানীয় এক হোমিও চিকিৎসক আমার গানের বেশ মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন। কিন্তু কেন জানি, তিনি আমার কণ্ঠে লালনগীতি শুনতে চাইতেন। তাঁর মনে হতো, লালনের গান আমার কণ্ঠে বেশি ভালো লাগবে। তাই হঠাৎ করেই আমাকে একদিন লালন ফকিরের গান শেখার পরামর্শ দেন। কিন্তু শুরুতে লালনের গান গাইতে চাইনি। আমার এই অনীহা দেখে বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়ে গান শেখার জন্য রাজি করান। বলেন, “ভালো না লাগলে গাইবি না।” এই শর্তে রাজি হই এবং লালনসংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে তালিম নেওয়া শুরু করি। “সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন”, লালনের বিখ্যাত গানটি শিখি। একই বছর দোলপূর্ণিমা উৎসবে গানটি গাইলে শ্রোতারা আমাকে লালনের আরও একটি গান গাইতে অনুরোধ করেন। তখন আমি গান গাইতে অসম্মতি জানাই। শ্রোতাদের বলি, “আমি একটি গান গাইতে শিখেছি। এটাই ভালোভাবে গাইতে চাই।” এ গানই আমার নতুন পথের দিশা হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে বুঝতে শিখি, কী আছে লালনের গানে। তাঁর গানে মিশে থাকা আধ্যাত্মিক কথা ও দর্শন আমাকে ভাবিয়ে তোলে। এ পর্যায়ে অনুভব করি, লালন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অনবদ্য এক স্রষ্টা হয়ে উঠেছেন। এটা বোঝার পর লালনের গান ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারি না।’
কণ্ঠে দার্শনিকতার মূর্ছনা
ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, ‘নিন্দার কাঁটা’ কিংবা ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’—শুধু গান নয়, মানুষের আত্মাকে নাড়া দেওয়া এক দর্শন। তাঁর কণ্ঠে লালন যেন নতুন ভাষা খুঁজে পেত। তিনি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘লালনের গান গাইতে গাইতে বুঝেছি, তাঁর বাণীতে যে আধ্যাত্মিকতা আছে, তা আমাকে ভেতর থেকে নাড়া দেয়। এই গান ছাড়া আমি অন্য কিছু ভাবতেই পারি না।’
বিশ্বমঞ্চে লালনের জয়যাত্রা
শুধু বাংলাদেশ নয়, লালনের গান তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বমঞ্চেও। জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য—সবখানেই তাঁর কণ্ঠে বেজেছে লালনের দর্শন। সুইডেন সফরের সেই ঘটনা আজও কিংবদন্তি—যেখানে রানী তাঁর গান শুনে অশ্রুসিক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি কথাগুলো বুঝি না, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে যে বেদনা আছে, তা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।’ ৫৫ বছরের সংগীতজীবনে ফরিদা পারভীনের অনেক স্মরণীয় স্মৃতি আছে। সে রকম একটি ঘটনার কথা এভাবেই বলেছিলেন, ‘১৯৭৩ সাল। বিভিন্ন আখড়া থেকে বাউলশিল্পীদের ঢাকায় এনে লালনের গান রেকর্ডের পরিকল্পনা করেন ওস্তাদ মকছেদ আলী সাঁই। তিনি তৎকালীন রেডিওর ট্রান্সক্রিপশনে কর্মরত ছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণে ঢাকায় রেডিওতে আসি। এ সময় স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন আবদুল হামিদ চৌধুরী, কমল দাশগুপ্ত, সমর দাস, কাদের জমিলির মতো বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞরা। খুব ভয় হয়েছিল। তাঁদের সামনে আমাকে গাইতে হলো। ১৫ মিনিটের একক সংগীতানুষ্ঠান করে তাঁদের প্রশংসা পেয়েছিলাম। এটিই আমার অন্যতম স্মরণীয় স্মৃতি।’ ২০০১ সালে ‘ফরিদা পারভীন প্রজেক্ট কমিটি’র উদ্যোগে তিনি জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লালনের গান পরিচয় করিয়ে দেন। পরে গড়ে তোলেন ‘ফরিদা পারভীন ট্রাস্ট’, যার লক্ষ্য ছিল লালনের গান সংরক্ষণ, স্বরলিপি তৈরি এবং বাদ্যযন্ত্রের আর্কাইভ তৈরি করা।
স্বীকৃতি
লালনসংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে একুশে পদক পান তিনি। ১৯৯৩ সালে চলচ্চিত্র ‘অন্ধ প্রেম’-এ ব্যবহৃত তাঁর গাওয়া ‘নিন্দার কাঁটা’র জন্য পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০০৮ সালে জাপানের মর্যাদাপূর্ণ ফুকুওয়াকা পুরস্কারে ভূষিত হন। তবে পুরস্কার-সম্মান নয়, তাঁর কাছে আসল অর্জন ছিল মানুষের ভালোবাসা। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমার গানের শ্রোতা যখন কাঁদেন, হাসেন, আবেগে ভেসে যান—সেটাই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।’
ব্যক্তিজীবন
ব্যক্তিজীবনে তিনি একসময়ের জনপ্রিয় গীতিকার ও সুরকার আবু জাফরের স্ত্রী ছিলেন। তাঁদের সংসারে এক মেয়ে ও তিন ছেলে। আবু জাফরের লেখা-সুর করা অনেক গানই তাঁর কণ্ঠে অমর হয়ে আছে। যেমন, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’, ‘তোমরা ভুলে গেছো মল্লিকাদির নাম’, ‘নিন্দার কাঁটা’। তবে দাম্পত্যজীবনে বিচ্ছেদ ঘটলেও গানই ছিল তাঁর চিরসঙ্গী। ২০০৫ সালের ১৭ জানুয়ারি তিনি বংশীবাদক গাজী আবদুল হাকিমের সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে জড়ান।
শেষ জীবন
শেষ সময় জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন। ডায়ালাইসিসের পরও তাঁর শিল্পীসত্তা কখনো ক্লান্ত হয়নি। হাসপাতালের বিছানায় থেকেও তাঁর মনে ছিল গান। অবশেষে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। সেই সঙ্গে বাংলার সংগীতের আকাশের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র অস্ত গেল। নিভে গেল এক কণ্ঠস্বর, যে কণ্ঠ শুনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লালনকে নতুনভাবে চিনেছে।
Comments