বইমেলার দশমতম দিন। করোনা মহামারির কারণে বিগত দুই বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে বইমেলা শুরু হয়নি। তবে এবার দ্বিতীয় বারের মতো প্রথম দিন থেকেই বইমেলা শুরু হয়েছে। মাসব্যাপী বইপ্রেমী ও প্রকাশকদের বার্ষিক অনুষ্ঠান অমর একুশে বইমেলা-২০২৪ উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট ২০ বার প্রধান অতিথি হিসেবে একুশে বইমেলার উদ্বোধন করেছেন শেখ হাসিনা।
১ লা ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বিকালে সরাসরি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদান করে দেশের বৃহত্তম বইমেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগৃহীত রচনা: দ্বিতীয় খন্ড'সহ কয়েকটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন ৷
একাডেমি প্রাঙ্গণ ও এর পার্শ্ববর্তী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘(পড়ো বন্ধু গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’) প্রতিপাদ্য নিয়ে এ মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।মোট ৩৭টি প্যাভিলিয়নসহ বইমেলায় ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৯৩৭টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৷ বাংলা একাডেমি মাঠে ১২০টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৩টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৫১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৬৪টি স্টল বরাদ্দ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ৷গত বছর ৬০১টি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মোট ৯০১টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল৷প্রতি কর্মদিবসে বইমেলা বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এবং সরকারি ছুটির দিনে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং দুপুরের খাবার ও নামাজের জন্য এক ঘণ্টা বিরতি থাকবে৷পৃথিবীতে যত রকমের মেলা হতে পারে তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর মেলা হচ্ছে বইমেলা। আমার ধারণা পৃথিবীতে যত বইমেলা আছে তার মাঝে সবচেয়ে মধুর বইমেলা হচ্ছে আমাদের ফেব্রুয়ারি বইমেলা।
কোনো কিছু না করে বইমেলার এক কোনায় চুপচাপ বসে থেকে শুধু মেলার মানুষজনকে দেখে আমি আমার একটি জীবন কাটিয়ে দিতে পারব! মেলায় গুরুগম্ভীর বয়স্ক মানুষ যায়, কমবয়সী তরুণ-তরুণী যায়, বাবা-মায়ের হাত ধরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যায়, প্রত্যেকের ভাবভঙ্গি চালচলন আলাদা! কেউ বই কেনে, কেউ বই দেখে আবার কেউ শুধু ঘুরে বেড়ায়!
এই অতি চমৎকার বইমেলাটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুরু হয়েছে, আমি চট্টগ্রামে বসে আছি, লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপেক্ষা করছি কবে বইমেলায় যাব!
আর আজকাল আমরা বইপড়া প্রায় ভুলে যেতে বসেছি। বই পড়ার দিকে আমাদের যতটা না মনোযোগ, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহ ফেসবুকের প্রতি। ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্টারনেট আর মোবাইলের নেশায় আমরা প্রকৃত বইপড়ার আনন্দটাই ভুলে যেতে বসেছি।
বই হতে পারে উপহারের একটি উপকরণ। সেটাও যেন বিলীন হতে বসেছে। প্রিয়জনকে বেশি বেশি বই উপহার দিলে, নিজে বই কিনলে এবং নিয়মিত বই পড়লে, বইকে নিত্যসঙ্গী করতে পারলে যেমন নিজের জ্ঞানের পরিধি বাড়ে, তেমনি সুস্থ, সুন্দর জীবনযাপন করা যায়। বই হল প্রকৃত বন্ধু, বই হল বিপদের বন্ধু- যাকে সবসময় কাছে পাওয়া যায়।
আজ সমাজে যত অপকর্ম, অন্যায়-অবিচার, ব্যভিচার, অনৈতিক কর্মকাণ্ড- সবকিছুর মূল হল জ্ঞানহীন, মূল্যবোধহীন সমাজব্যবস্থা। এর প্রধান কারণ হল বই থেকে, জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন। দেশি-বিদেশি অসংখ্য টেলিভিশন চ্যানেল বিনোদনের নামে আমাদের অনেক কর্মঘণ্টা কেড়ে নিচ্ছে। অথচ বিনোদনের এ আনন্দটুকু আমরা নির্ভেজালভাবে অনায়াসেই নিতে পারি বই পড়ার মাধ্যমে
> বই যে আমার প্রিয় বন্ধুঃ-
এই মানব জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো বই।বই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। ‘বন্ধু’ শব্দটি কতই মধুর! বন্ধুত্ব নৈকট্যের পরিচয়বাহী, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও হৃদ্যতা এবং পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও মানসিক বন্ধনের প্রতীক। বন্ধুত্বের ফাটল বেদনাদায়ক হলেও অস্বাভাবিক নয়; যখন তখন লক্ষণীয়। অনেকে আজ বন্ধু কাল শত্রু। বন্ধু হয়ে বেঈমানি আর বিশ্বাসঘাতকতা কারো কাম্য নয়। কিন্তু অপ্রত্যাশিত হলেও অহরহ ঘটছে। শুধু বন্ধু কেন পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্বে বাবা-মা, ভাইবোন, নিকট আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে দূরত্ব। ছড়িয়ে পড়ছে হিংসা হানাহানি। পিপীলিকা যেমন বিপদে পানিতে পতিত গাছের পাতাকে বাঁচার অবলম্বন করে নেয়, তেমনি মানুষও বিপদ হতে বাঁচতে চায়, একটু আশ্রয় খোঁজে। প্রয়োজন হয় ভালো বন্ধুর। রক্ত মাংসে গড়া মানুষকে যেখানে বন্ধু হিসেবে ভেবেও সন্দেহ হয়, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল কাজ করে, সেখানে মানুষের প্রকৃত বন্ধু হতে পারে বই।আর পড়তে শেখার পর থেকেই বিভিন্ন গল্পের বই পড়তে শুরু করি। খুবই ভালো লাগতো গল্পের বই পড়তে। কখনও বা অভিনয় করে পড়তাম।
ছোটবেলা থেকেই খুব বই পড়তে ভালোবাসি। যে বইটা পড়তে শুরু করি সেটা শেষ না করলে ভালোই লাগেনা। আর সেই ছোট কাল থেকেই বইয়ের প্রতি আমার আকর্ষণ রয়েছে। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন বই পড়ি।কেউ যদি আমাকে বই উপহার দেয় তাহলে আমি খুব খুশি হই। বই উপহার পাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ আছে তা অন্য কিছুতে নেই। আর এসএসসি পরীক্ষার পর অবসরে প্রচুর বই পড়েছি আমি। আমি জানি এগুলো আমাকে কীভাবে সমৃদ্ধ করেছে।আর বই পড়ে মানুষ অজানাকে জানতে পারে অচেনাকে চিনতে পারে।
তাই বই বিশ্বাসের অঙ্গ জীবন যুদ্ধের হাতিয়ার। বই আমাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে এনে আলোর দিকে নিয়ে আসে।বই অন্ধকার দূর করে সভ্যতার অগ্রগতি ঘটায়। তাই বই যেমন সভ্যতার রক্ষাকবচ তেমন সভ্যতার চাবিকাঠি। সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে বই অতীত ও বর্তমানের বহুমুখী জ্ঞান সম্পদকে বহন করে চলেছে।
> পাঠাগার ভান্ডারঃ-
বই পড়া সকল দেশের মানুষের কাছে একটি শখের বিষয়। বিভিন্ন রুচির মানুষ তাদের রুচি মাফিক বইয়ের পাতায় চোখ রেখে শখ চরিতার্থ করে।মানুষের পুরো মনটার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় সাহিত্যে। তাই আমাদের বই পড়তেই হবে। কারণ বই পড়া ছাড়া সাহিত্য পাঠ নেই। এই চর্চার জন্য একক গ্রন্থ সম্ভব নয় চাই লাইব্রেরী।
ধর্ম-দর্শন নীতি,বিজ্ঞানের চর্চা যথাক্রমে মন্দির, গুহা, ঘর এবং গবেষণাগারে করা গেলেও বিদ্যা সংগ্রহ ও চর্চার জন্য পাঠাগারই একমাত্র স্থান।
> বই আমাদের আনন্দ এবং মানসিক সুস্থতাঃ-দেহের খাদ্য ভাত, রুটি মনের খাদ্যের যোগান দেয় বই।মনের সুস্থতার ওপর অনেকাংশে দেহের সুস্থতা নির্ভর করে। মনকে সুস্থ রাখতে হলে ভালো বই পড়া দরকার। ভালো বই পড়াশোনার মধ্য দিয়ে মানুষের মনে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে চেতনা জাগে।
তাছাড়া আমরা দেখি যে মানুষেরা বইকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে তাদের অনেক শত্রু কম। বই পড়ার মাধ্যমে আমাদের মন ভালো থাকে আমাদের মন প্রসন্নতায় ভরে যায়। তাই বই জ্ঞানের প্রতীক বই আনন্দের প্রতীক।
> বই সংস্কার থেকে মুক্তিঃ-মানুষ জীবনে তিনটি জিনিস কামনা করে পুরুষ, স্ত্রী এবং বই।
অবশ্য এই সহচর নির্বাচনে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। বইয়ের ক্ষেত্রে যার বই পড়তে ভালো লাগে তাকে সেই বই পড়তে দেওয়া উচিত। তাহলে তার কাছ থেকে নতুন চিন্তার ফসল পাওয়া সম্ভব হবে।
জীবনকে বুঝতে হলে অভ্যাসের সংস্কারের বেড়া ভাঙতে হলে বইয়ের সঙ্গ আমাদের অবশ্য প্রয়োজন।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের সবার নিয়মিত বই পড়া উচিত। প্রতিটি পরিবারে একটি করে লাইব্রেরি থাকা উচিত। সেখানে থাকতে হবে বিভিন্ন ধরনের বই। এর ফলে পরিবারের সদস্যরা সহজেই বই পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। সবার হৃদয়ে জ্ঞানের আলো প্রবাহিত হবে। বই পড়ার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সব বিষয়ে কম-বেশি জ্ঞান অর্জন করতে পারে।আর বই যে জীবনের কত প্রশ্নের উত্তর জোগায়, তা বলে শেষ করার উপায় নেই। বই হচ্ছে মানুষের চিন্তার লিখিত ভাস্কর্য। বই ও বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম।একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের গর্বের অংশ। অধিক পাঠাভ্যাসের মাধ্যমে সার্থক হয়ে উঠুক গ্রন্থমেলা। আমরা বই কিনব, বই পড়ব, প্রিয়জনকে বই উপহার দেব। বই হোক আমাদের নিত্যসঙ্গী। সার্থক হোক অমর একুশে বইমেলা।
লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
ইমেইল, [email protected]
Comments