লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। কোনো ক্রমেই পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রনে রাখা যাচ্ছে না। ধারাবাহিক ভাবে হু হু করে পেঁয়াজের দাম বেড়েই চলেছে। কেন এমনটি হচ্ছে, বহুবিধ প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের ভেতরে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পেঁয়াজের দামের উর্ধ্বগতি দেখে সাধারণ মানুষ এখন দাম আতঙ্কে ভুগছে।
এমন অস্থিরতা দেখে দেশের সাধারণ মানুষের ভেতরে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এদিকে ঊর্ধ্বমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রিতে সীমিত আয়ের মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে গুনতে হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। শেষ এক সপ্তাহে কেজি প্রতি দাম ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দেড় মাসের ব্যবধানে হয়েছে দ্বিগুণ। যদিও মাত্র কয়েক মাস আগেই পেঁয়াজের ভরা মৌসুম শেষ হয়েছে। বাজারে এখনো দেশি পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। যেখানে আগামী মৌসুম আসতে আরও প্রায় এক-দুই মাস বাকি। যে কারণে এখন সাধারণ মানুষের কাছে বড় প্রশ্ন, মৌসুমের শেষে এ বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটির দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে? তবে এ প্রশ্নের সদুত্তর নেই কারো কাছেই।
বাংলাদেশে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার ঘটনা গত কয়েক বছরে ঘটছে। ২০১৯ সালে ঘাটতি দেখা দিলে কার্গো বিমানে জরুরি ভিত্তিতে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়েছে। তবে ওই সময়ও সেসব পদক্ষেপে খুব বেশি সুফল আসেনি। আড়াইশ টাকা দরে পেঁয়াজ কিনে খেয়েছে মানুষ। দ্রুত বেড়ে চলা এ পণ্যটির দাম কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি।
মিসর, তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ এনে ব্যবসায়ীরা ২০১৯ সালে কোটি কোটি টাকা লোকসান করেছেন। এক কোটি টাকার পেঁয়াজ ২০ লাখ টাকা বিক্রি হয়নি। পচে নষ্ট হয়েছে। সে ঝুঁকি এবার সিন্ডিকেটের কোনো সদস্য নিচ্ছে না।
এ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পেঁয়াজের দাম এবার স্থিতিশীল থাকবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। দাম আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিতে পারে, যদি সময়মতো সঠিক কোনো পদক্ষেপ নেয়া না হয়। আগে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়লে ভারত থেকে আমদানি করে বাজার স্থিতিশীল করা হতো। এবার ভারতে পেঁয়াজের উৎপাদন কমেছে। যে কারণে সে দেশেও পেঁয়াজের দাম বেশি। ভারতে পেঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য (এমইপি) এখন টনপ্রতি ৫৫০ মার্কিন ডলার। যা আমদানি করতে আরও প্রায় ৪০ শতাংশ শুল্ক-কর রয়েছে। এতে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে কেজিপ্রতি খরচ পড়ছে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯০ টাকা। যে কারণে এখন খুব বেশি পেঁয়াজ আমদানি করছেন না বাংলাদেশের আমদানিকারকরা।
সরকারিভাবে পেঁয়াজের দাম কমানোর জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কি-না, ভারত থেকে আমদানি বাড়াতে কোনো উদ্যোগ বা বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির কোনো পদক্ষেপ আছে কি-না এমন বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ নেই। যদিও মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি) অনুবিভাগের প্রধান অতিরিক্ত সচিব বলেন, এখনো কিছু চূড়ান্ত নয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও কিভাবে পেঁয়াজের দাম কমানো যায় সে পথ খুঁজছে। আমরা আলোচনার মধ্যে আছি। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত এখনো আসতে পারিনি।
পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত। আর মৌসুম শেষ হতে না হতেই বাজারে অস্থিরতা। ২০১৯ সাল থেকে প্রতি বছরই মৌসুম শেষে পেঁয়াজের দাম বাড়ে। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি আগেই উত্তপ্ত হয়েছে। নতুন মৌসুম এখনও তিন মাস দূরে। অথচ দাম চড়া হয়ে উঠেছে। সাধারণ ভোক্তাদের শঙ্কা, দাম আরও বাড়বে কি না।
এ বছর কৃষকের হাতে পেঁয়াজের মজুত কম। গত বছর থেকে পেঁয়াজের দাম অস্থির হয়ে ওঠায় কৃষকরা আগেভাগে পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন। পাবনার সুজানগরের কৃষক মানিক হোসেন পাঁচ বিঘা জমির ৩০০ মণ পেঁয়াজ মার্চে বিক্রি করেছেন। যা পরিপক্ব হলে ৫০০ মণ হতে পারত। তিনি বলেন, আগের বছরগুলোর তুলনায় দাম দ্বিগুণ ছিল। লাভ বেশি হলেও উৎপাদন কমেছে।
মার্চ-এপ্রিল মাসে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের ৮০ শতাংশ হয়ে থাকে। এ সময় পেঁয়াজের দাম কম থাকে। কিন্তু অন্যান্য মাসে সরবরাহ কম থাকার কারণে দাম বাড়ে। বিশেষ করে সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে বাজারে ঘাটতি থাকে। তখন মজুতদাররা বাজারে সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন।
এ বছরের সেপ্টেম্বরেই বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, এ সময় পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় ঘাটতি থাকে। এবার পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা পূরণে দেশীয় উৎপাদন ছাড়াও আমদানির প্রয়োজন হয়। ভারত থেকে আমদানি কমে যাওয়ায় বিকল্প উৎস হতে হবে। মিয়ানমার, মিসর, তুরস্ক ও চীন থেকে আমদানি প্রয়োজন। তবে এ পথে ঝুঁকি রয়েছে।
আবদুল মাজেদ বলেন, ২০১৯ সালে মিসর ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ এনে ব্যবসায়ীরা বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাই এবার কেউ সে ঝুঁকি নিতে চাইবে না।
এদিকে উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে পেঁয়াজের দাম কমবে বলে আশা করা যাচ্ছে না। সরকারও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
Comments