কবি, লোকশিল্পী ও বাউল গবেষক রুবেল সাইদুল আলমের ‘ভবঘুরে অভিলাষ’ কবিতাগ্রন্থের পাঠ-উন্মোচিত হলো। গতবার শনিবার (৯ মার্চ) রাজধানীর বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের বাতিঘরে পাঠ-উম্মোচন করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ।
এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কথা-সাহিত্যিক নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর, কবি শামীম রেজা, কবি ও প্রাবন্ধিক কাজী শাহজাহান, ঢাকা বিজনেস সম্পাদক ও ভ্রমণগদ্য লেখক উদয় হাকিম প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে কবিতাগ্রন্থ থেকে নির্বাচিত কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করা হয়। আবৃত্তি করেন জনপ্রিয় আবৃত্তিশিল্পী তামান্না তিথি ও হাসান মেহেদী। অনুষ্ঠান আয়োজন করেন স্বদেশ শৈলী প্রকাশনীর প্রকাশক, অনুবাদক অনন্ত উজ্জ্বল।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, কবিতাগ্রন্থটি মূলত প্রেম-বিরহের অনবদ্য কথায় গাঁথা। কিন্তু এর মাঝে আছে প্রকৃতির কথা। প্রেম-ভাব-বিরহের কথা, আছে। আছে যাপিত জীবনের দ্যোতনা-ব্যঞ্জনা, টানা-পড়েন। আছে দ্রোহ, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সাহসী উচ্চারণ। আছে সমাজের বিভিন্ন সংকট ও অসঙ্গতির কথা। আছে নির্জনতার কথা। পরমের কাছে তার জীবের সমর্পিত আকুতি ও হিসাব আছে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ গল্পে গল্পে উপস্থিত সবাইকে মাত করে রাখেন প্রায় দু ঘণ্টা। তিনি তাঁর জীবনের নানান অধ্যায়ের বিভিন্ন গল্প করেন। কবি জানান, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা চুরি করে কবি হতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ধরা পড়ে যান । কবিতা আর ছাপা হলো না। কবি হতে পারলেন না সে যাত্রায়। খুব মজা করে বলছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ।
গল্পে-গল্পে জানালেন, তখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। তাঁর খুব ইচ্ছে যে, কবিতা কোথাও ছাপা হবে। কিন্তু তিনি পত্রিকার সম্পাদক বরাবর কবিতা পাঠিয়ে অপেক্ষা করেন, কবিতা আর ছাপা হয় না। তবু, চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তখন একদিন মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি কবিতা তাঁর চোখে পড়লো। তিনি ভাবলেন এই কবি মনে হয় খুব পরিচিত কেউ নন। এই ভেবে কবিতাটি কিশোর নির্মলেন্দু গুণ নিজের নামে পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দিলেন। আর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অপেক্ষা করতে থাকলেন। ভাবলেন, এবার তাঁর কবিতা ছাপা হবেই। কিছুদিন পর তিনি পত্রিকার সম্পাদকের কাছ থেকে একটি পোস্ট কার্ড পেলেন। যেখানে অন্যের কবিতা নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টার কারণে তাঁকে সতর্ক করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তিনি ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত পদক’ পান। সেই পদক নিতে গিয়ে তিনি মঞ্চে এই কথা ফাঁস করে দিলেন। আরও বলছিলেন তাঁর অসমাপ্ত কবিতা লেখার পেছনের গল্প, ‘হুলিয়া’ কবিতা লেখার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হওয়ার গল্পসহ অনেক গল্পের ঝাঁপি খুলে যেন বসেছিলেন তিনি সেদিন।
কবি শামীম রেজা বলেন, ‘ভবঘুরে অভিলাষ কবিতাগ্রন্থে র পাণ্ডুলিপি যখন আমি হাতে পাই, তখনই সবগুলো কবিতা পড়েছি। রুবেলকে আমি ছাত্রজীবন থেকেই খুব কাছ থেকে জানি। আমরা পরস্পর খুব ভালো বন্ধু। সে খুব ভালো গান করে। বাউল ও সুফিবাদ তার অন্যতম পছন্দের বিষয়। তার কবিতায় বাংলা সাহিত্যের অনেক কবির প্রভাব থাকলেও আমি গভীর ভাবে লক্ষ করেছি, এর মধ্যে একটা মরমি ভাব আছে। বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য কবিকে ধারণ করেও রুবেল তার মতো একটা নিজস্ব ঘরানা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।’
কথাসাহিত্যিক নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর বলেন, ‘কবিতা কাউকে দিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে লেখানো যায় না। এটা সহজাত। যিনি লেখেন তিনি নিজেই বোঝেন কোনটা কোন ধরনের কবিতা । কোনটা কবিতা, কোনটা কবিতা না।’ তিনি কবি রুবেল সাইদুল আলমকে সাধুবাদ জানান।
কবি ও প্রাবন্ধিক কাজী শাহজাহান বলেন, ‘এসব আয়োজনে কবিকে নিয়ে কিছু কথা বলা মুশকিল। কারণ কবি থাকেন আবেগতাড়িত। যারা বলেন, তারা থাকেন বিবেক লালিত। ফলে আবেগ ও বিবেকের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব লেগে কথার ছন্দপতন হতে পারে। রুবেলের পরিচয় তিনি একজন সিভিল সার্ভেন্ট। তার বাইরে তিনি একজন কবি। বাউল সাধক, গবেষক, আবার লেখাপড়ায় মাইক্রোবায়োলজির মতো একটি অসাহিত্যিক বিষয়ে। আবার আছে সেই ফিল্ডে একাধিক প্রকাশিত আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র। এখানেই দ্বন্দ্ব ঘটে ভাবনায়। এই বইটি তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, এটি তার প্রথম নয়, মনে হয়েছে নির্বাচিত কবিতা। প্রথম কবিতাগ্রন্থের এ রকম একটি অসাধারণ সন্নিবেশ সাধারণত হয় না। কবির নামের সঙ্গে তিনটি শব্দ রুবেল সাইদুল আলম এবং তার কবিতাগ্রন্থের নামে আছে দুইটি শব্দ ‘ভবঘুরে অভিলাষ’ । তার চল্লিশটি কবিতার মধ্যে আমি আটটি কবিতা পেয়েছি তিন শব্দের শিরোনামে। সুতরাং তিন শব্দে চক্রাকারে ত্রিকণাবৃত্তে কেন তিনি আবদ্ধ, তার কাছে এটি আমার একটি প্রশ্ন। আমার মনে হয় সবসময়ের কবিরা কবিতা লিখতে গিয়ে জীবনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। এখানে সেই চ্যালেঞ্জ কবি নিজেই নিয়েছেন। কারণ কবি নিজেই বলেছেন, আমি কারও উচ্ছি্বষ্ট সময়ের দোসর হতে চাই না। কেউ বাসুক কিংবা না বাসুক, আমি আমাকে ভালোবাসি, ভালো রাখি। স্বপ্ন দেখি সপ্ন গড়ি, স্বপ্ন দেখাই, ইচ্ছে ঘুড়ি ছেড়ে দিয়ে ঘুড়াই আমার মনের নাটাই। আমার এক বন্ধু বলেছিলেন আমি আমাকে চিনি, তেত্রিশ কোটি দেবতার চেয়ে আমিই বেশি দামি। আমার কাছে মনে হয়েছে, রুবেল সাইদুল আলমের নিজের ভেতর সেই কবি সত্তাটাই শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছেন।
Comments